আমরা সবাই দেশদ্রোহী: আনন্দ তেলতুম্বেরকে গ্রেফতার করে প্রতিবাদ রোখার চেষ্টা করা হচ্ছে

আতঙ্ক ছড়িয়ে প্রতিবাদ রুখতে করতেই প্রতিবাদীদের দেশদ্রোহী বা ভয়ঙ্কর মাওবাদীর আখ্যা দেওয়া হচ্ছে

 |  6-minute read |   08-02-2019
  • Total Shares

যাঁরা সম্পূর্ণ ভাবে স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক জীবনযাপন করেন তাঁদের একই আসনে বসানোর জন্য গুরত্বপূর্ন রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা 'আরবান মাওবাদী' শব্দযুগলটি তৈরি করেছেন।

যাঁরা যাঁরা শাসকরা বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন তাঁদেরকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়ার জন্য এবং তাঁদেরকে হিংসা ছাড়ানোর মিথ্যে অভিযোগে অভিযুক্ত করার জন্যেই এই শব্দযুগলকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

প্রান্তিক মানুষজনের কল্যাণের কথা ভেবে যাঁরাই মুখ খুলেছেন তাঁদেরকে 'আরবান মাওবাদী' আখ্যা দিয়েছেন শাসকরা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, শাসকদলের সভাপতি অমিত শাহ এমনকি বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি সকলকেই এই একই পথে চলতে দেখা গিয়েছে।

এই ধরনের উক্তি ব্যবহার করলে যদি আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়া যায়।

body_020819010548.jpgবামপন্থী সমাজ কর্মীদের গ্রেপ্তারের পর প্রতিবাদ মিছিল [ছবি: পিটিআই]

এর পরেই এই আখ্যা পাওয়া আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করতে তৎপর হয়ে ওঠে পুলিশ। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর ধারা প্রয়োগ করে তাঁদের জেল হেপাজতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বছরের পর বছর তাঁদের জামিন মঞ্জুর হয় না। এমনকি, তাঁদের নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করারও সুযোগ দেওয়া হয় না। তাঁদের প্রতি এই ধরণের আচরণ আদতে বাকিদের সতর্ক করা যে বাকিরা মুখ খুললে তাঁদের পরিণামও এমনটাই হবে।

সম্প্রতি বিজেপির তত্বাধানে যাঁদের যাঁদের 'মাওবাদী' অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং 'দেশদ্রোহী' আখ্যা দেওয়া হয়েছে তাঁদের বেশিরভাগই শিক্ষাবিদ এবং স্বাধীনচেতা। সাধারণ মানুষের কাছে মাওবাদী বা নকশাল মানেই একটা নিন্দার বিষয় এবং ধ্বংসের প্রতীক। অঙ্ক কষেই এই পদক্ষেপ করা হয়ে থাকে যাতে অভিযুক্তদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয় এবং তাঁরা যেন অন্যায়ের (শাসক স্বীকৃত) প্রতিবাদ করে। সাধারণ মানুষ এমনিতেই আতঙ্কে থাকে। আর এই পরিস্থিতির ফলে আতঙ্ক খানিকটা বেড়ে যায়, তাই চুপ করে থাকাটাই এখন।

body1_020819010628.jpgপ্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও আরবান মাওবাদী শব্দযুগল ব্যবহার করেছিলেন [ছবি: পিটিআই]

এই তালিকার নবতম সংযোজন গোয়ার ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের আধ্যাপক আনন্দ তেলতুম্বের গ্রেফতারি। তিনি শুধু একজন উচ্চমানের শিক্ষাবিদই নন, তিনি লেখক, সমাজকর্মী এবং বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ের উপর তাঁর অগাধ জ্ঞান।

কেউ যদি ইউএপিএ ধারায় গ্রফতার হন তা হলে দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টিকে দেখা উচিত। আমাদের বুঝতে হবে, 'দেশদ্রোহী' আর 'সন্ত্রাস' এই শব্দ দু'টি আমাদের চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। সঠিক প্রমাণ ছাড়াই অভিযুক্তদের কারাবাসে পাঠিয়ে একঘরে করে দেওয়ার ছক।

সুতরাং, ঠিক কোন ধারায় গ্রেফতার করা হল বা আইনসঙ্গত ভাবে গ্রেফতার করা হল কি না, সে বিষয়ে আমাদের প্রশ্ন করা উচিত।

এই আইনগুলো আমাদের দোহাই দিয়ে তাঁরা তৈরি করে থাকেন যাঁদের গণতন্ত্র রক্ষার জন্যে আমরা নির্বাচিত করে থাকি।

 

প্রথমেই আমাদের একবার আইনটাকে খতিয়ে দেখে নেওয়া উচিত। বিভিন্ন সরকারই স্ট্রেস বিরোধী আইন তৈরি করেছে। যার মানে বেআইনি চিন্তা বা 'অপরাধমূলক চিন্তা'। ইউএপিএ ধারায় একজনকে অভিযুক্ত করা সম্ভব যখন তিনি কোনও 'বেআইনি কার্যকলাপ' করবেন। 'বেআইনি কার্যকলাপ'-কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, ভারতের বিরুদ্ধে তিনি "প্রশ্ন করেছেন, কাজে বাধা দিয়েছেন কিংবা প্রতিবাদ স্বরূপ কোনও কাজ করেছেন'। একই ভাবে আইপিসি-র ১২৪এ ধারায় বলা হয়েছে কেউ যদি "সরকারের বিরুদ্ধে কোনও চক্রান্ত করার চেষ্টা করেন' তাহলে তিনি দেশদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত হবেন।

দেখলেই স্পষ্ঠ বোঝা যাচ্ছে, আমাদের শব্দ রোধ করতেই ইউএপিএ ও ১২৪এ ধারার বিষয়বস্তু ঠিক করা হয়েছে ও এই দু'টি ধারা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এই ধরণের শব্দ চয়ন ব্যবহার করা হয়েছে। যে ভাবে এই ধারা দু'টিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাতে যে কাউকেই সহজেই দেশদ্রোহীর আখ্যা দিয়ে যাওয়া যায়।

ইচ্ছে করেই, বিষয়গুলোকে এই ধরণের সাবজেক্টিভ করে রাখা হয়েছে।

কেলেঙ্কারি বিরুদ্ধে মুখ খুললে, পরিষেবা না পেলে মুখ খুললে, দরিদ্রদের ন্যায়ের দাবিতে মুখ খুললে কি কেউ দেশদ্রোহী হয়ে যেতে পারে?

ইউএপিএ ছাড়াও ছত্তিশগড়ে আরও একটি বিশেষ আইন রয়েছে যা সরকার যে কোনও সময়ে যে কোনও প্রতিবাদকারীর উপর আক্রমণ করতে পারে।

body2_020819010811.jpgবামপন্থী সমাজকর্মীরা বিদ্বজনেদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করেছিলেন [সৌজন্যে: ইন্ডিয়া টুডে]

হার্দিক প্যাটেল কিংবা কানহাইয়া কুমারের মতো তরুণ নেতাদের কী ভাবে দেশদ্রোহীর তকমা দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে একটু ভাবতে বসলেই আমরা আসল সত্যিটা বুঝতে পারব। আমাদের গণতন্ত্রের উপর এর কী প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে।

এই ধরণের চেষ্টা কাদের বিরুদ্ধে হয়েছে সেই তালিকায় একবার চোখ বোলালেই দেখ যাবে যে আক্রমণের চেষ্টা সেই সব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হয়েছে যাঁরা আন্দোলন করে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে চেয়েছেন।

রাজনৈতিক লড়াইয়ে এমনিতেই একজনকে বারংবার গ্রেফতারের নজির রয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার ভয় তার উপর আবার আরবান মাওবাদী শব্দযুগলের প্রচলন করা হয়েছে। সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ বা দার্শনিকদের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ করা হয়ে থাকে। এরা কিন্তু সরকারি স্বার্থ সিদ্ধিতে এরা কোনও মতেই বড় বাধা হয়ে দাঁড়ান না। কিন্তু এদের গ্রেফতারিতে একটি বিশেষ চিন্তাধারাকে দেশদ্রোহিতার তকমা দিয়ে দেওয়া যায়।

body3_020819010915.jpgকানহাইয়া কুমারকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়ায় প্রচুর বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল [ছবি: পিটিআই]

যাঁরা নিজেদের চিন্তা জনসমক্ষে লেখেন বা বলেন তাঁরা কী ভাবে রাজ্যের বিরুদ্ধে গোপন চক্রান্ত করতে পারেন?

শাসকদের বিরুদ্ধে মুখ খুলে জাতীয় স্তরে জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন কানহাইয়া। একটি কলেজে আন্দোলনের তদন্ত করতে গিয়ে প্রায় দু'বছর বাদে দেশদ্রোহী বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাঁকে। এছাড়া আরও দশজনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের বয়স সত্তরের বেশি। এরা প্রত্যেকেই স্বনামধন্য এবং প্রান্তিক মানুষদের হয়ে সওয়াল করেছিলেন।

আসলে সরকার বোধহয় প্রান্তিক মানুষদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকেই ভয় পায়। যে দশজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁরা সরকারি আক্রমণের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে এমন কিছুই নেই যার থেকে প্রমাণিত হয় যে তাঁরা দেশের সংবিধানের উপর আঘাত হানতে পারেন। এবং তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরও তাঁরা কিন্তু পালিয়ে যাননি বা লুকিয়ে পড়েননি।

body4_020819011000.jpgতেলতুম্বের অন্যায় একটাই, তিনি প্রান্তিক মানুষদের হয়ে মুখ খুলেছিলেন [সৌজন্যে: টুইটার]

আনন্দ তেলতুম্বেকে যে ভাবে ভোররাতে বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হল তাতে মনে হল তিনি যেন পালিয়ে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু তিনি তো বরাবরই ন্যায় এবং গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলেই এসেছেন। তিনি শুধু দলিত নন সকল শোষিত জাতির হয়েই কথা বলে থাকেন।

বলা যেতেই পারে - যদি আনন্দ তেলতুম্বে দেশদ্রোহী কিংবা ভয়ঙ্কর মাওবাদী হয়ে থাকেন, তাহলে আইনের চোখে আমরাও তাই।

সরকার যে বার্তাটা পাঠাতে চাইছে তা পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, "আজ যদি আনন্দ তেলতুম্বে হয় তাহলে আগামিকাল আপনিও হতে পারেন।"

সরকারের উচিত নৈতিকতার দায়ে নিজেদের অবস্থান খোলসা করা।

মানুষদেরও এই 'আতঙ্কের' রাজনীতি বুঝতে হবে। যে কোনও সরকারই এর ব্যবহার করতে পারে। আজকে, যাঁরাই গণতন্ত্র রক্ষার জন্য মুখ খুলছেন তাঁদের উপরই আক্রমণ করা হচ্ছে। কিন্তু সকলকে বুঝতে হবে সরকারের এই মনোভাবের জন্য দেশের গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক মূল্যের ক্ষয়ে হচ্ছে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ARUNA ROY ARUNA ROY

Author is a civil and farmer rights activist.

Comment