বিজেপির সংগঠন নেই, তবে তৃণমূলের সংখ্যালঘুপ্রীতিই জঙ্গলমহলে জাগাচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদ

বাম-রামের মিশেলে পুরুলিয়ার লালমাটি গেরুয়া হয়ে উঠেছে

 |  4-minute read |   07-06-2018
  • Total Shares

দুই বিজেপি কর্মী ত্রিলোচন মাহাত এবং দুলাল কুমারের মৃত্যু জঙ্গলমহলে রাজনৈতিক হিংসাকে আবার স্পটলাইটে ফিরিয়ে এনেছে। একসময় পুরুলিয়ার লালমাটি আরও লাল হয়ে উঠেছিল মাওবাদীদের হাতে নিহত বাম কর্মীদের রক্তে।

এখন এই দুই মৃত্যুর ফলে কী আমরা সেই অশান্ত আবহের দিকে আবার ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত পাচ্ছি?

২০১১ থেকে শুরু হওয়া বামেদের রাজনৈতিক রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে ফলাফল পরিষ্কার করে দিয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গের বুকে বিজেপি এখন প্রধান বিরোধী শক্তি। লাল শিবিরের ছেড়ে যাওয়া জমি দ্রুত গতিতে দখল নিচ্ছে বিজেপি। জঙ্গলমহলেও এই চিত্রটা ব্যতিক্রমী নয়।

body1_060318070408_060718042009.jpgগ্রামের অদূরেই মেলে ত্রিলোচনের ঝুলন্ত দেহ

আদিবাসী অধ্যুষিত এবং নিতান্তই পিছিয়ে পড়া জঙ্গলমহলের জেলাগুলো আজ বাংলার বুকে হিন্দুত্বের নতুন গবেষণাগার হয়ে উঠেছে। বিগত কয়েক বছরে এ সব অঞ্চলে আরএসএস, বজরং দল এবং সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা সংগঠনগুলো তৃণমূল স্তরে ভালোই প্রভাব বিস্তার করেছে। তার ফলে পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই অঞ্চলে বিজেপির ভালো ফলাফল একেবারেই আকস্মিক নয়। সারা রাজ্য যেখানে প্রায় বিরোধী শূন্য সেখানে পুরুলিয়া ও পার্শ্ববর্তী ঝাড়গ্রাম জেলায় শাসকদলের বিরুদ্ধে সেয়ানে-সেয়ানে লড়াই করেছে বিজেপি।

পশ্চিমবঙ্গের সব নির্বাচনই হিংসার আবহে হয়। তাই রাজনৈতিক হত্যা এ রাজ্যে নতুন কিছু নয়। কিন্তু পুরুলিয়ার দুই বিজেপি কর্মীর মৃত্যু কি নতুন কোনও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে, যে পরিবর্তনের মাধ্যমে বিরোধী শক্তি সমান ভাবে শাসকদলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে?

সম্প্রতি এ রাজ্যে বিজেপির অনেক কর্মীই মারা গেছেন। কিন্তু কোনও মৃত্যুকেই হাতিয়ার করে গেরুয়া শিবিরের পক্ষ থেকে এ ভাবে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করা হয়নি। অথচ, কলেজপড়ুয়া ত্রিলোচন মাহাত এবং রাজনৈতিক কর্মী দুলাল কুমারের ঝুলন্ত দেহকে একটা শক্তিশালী হাতিয়ার করে তুলেছে বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তিবিভাগ। মমতা যখন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী হতে চাইছেন তখন এই ছবিকে হাতিয়ার করেই মমতার ভাবমূর্তিকে অগণতান্ত্রিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করবার মরিয়া চেষ্টা করে চলেছেন বিজেপি নেতৃত্ব।

পুরুলিয়াতে সঙ্ঘ পরিবার

১৯ বছরের ত্রিলোচন সদ্য রাজনীতিতে পা রেখেছিল। তার গ্রাম চিরকালই তৃণমূল বিরোধী। ত্রিলোচনের বাবা একনিষ্ট সিপিএম সমর্থক ছিলেন। বামমনষ্ক পরিবার থেকে উঠে এসে ত্রিলোচনের গেরুয়া শিবিরে নাম লেখানো যথেষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।

মোদীর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন বলরামপুর কলেজের তৃতীয় বর্ষের ইতিহাসের ছাত্র ত্রিলোচন। প্রত্যন্ত সুপুরদি গ্রামে তাঁর নিজের ঘরে চারিদিকে হিন্দু দেবদেবীর ছবির পাশে স্থান পেয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের পোস্টার।তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরির প্রথম পাতায় নিজের হাতে লেখা নরেন্দ্র মোদীর নাম। পাতার ছত্রে ছত্রে তৃণমূল বিরোধী আওয়াজ এবং মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে স্লোগান।

যে জঙ্গলমহলকে মমতা সর্বদাই নিজের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতেন, সেই জঙ্গলমহলের যুবসমাজ কী ভাবে আজ তৃণমূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল? কাজ যে হয়নি তা নয়। নতুন রাস্তা ঘাট হয়েছে, বিদ্যুৎও পৌঁছেছে, রেশনও পাওয়া যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও, যুব সমাজের মনে কোথাও যেন একটা ক্ষোভ। এই ক্ষোভ চাকরি না পাওয়ার ক্ষোভ। বেকারত্বের জ্বালা এবং নিচুতলার তৃণমূল কর্মীদের দুর্নীতি তাদের এই ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

body_060718042057.jpgনিহত দুলাল কুমারের স্ত্রী

ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বাংলার এই সব অঞ্চলের বেশির ভাগ যুবকই আজ রাজ্যের বাইরে অন্য রাজ্যে গিয়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। ত্রিলোচনের দুই দাদার একজন গোয়ার পাঞ্জিমে ও আর একজন জামশেদপুরে কাজ করেন।

সুপুরদি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ডাহা গ্রাম। এখানে বিজেপি কর্মী দুলালকুমারের মৃতদেহ একটি বিদ্যুতের খুঁটি থেকে ঝুলতে দেখা গিয়েছিল। গ্রামে কথা বললে বোঝা যায়, বজরং দলের প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে এই গ্রামে। এখানে বিজেপি নেই কিন্তু বজরং দলের নেতারাই বিজেপির টিকিটে বিপুল ভোটে জিতেছেন।

এখানে জয় শ্রীরাম ধ্বনি তৃণমূলের উন্নয়নের স্লোগানকে ঢেকে দিয়েছে। তৃণমূল সরকারের সংখ্যালঘুপ্রীতি স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে ব্যাপক ভাবে। ইসলামিক আগ্রাসন এবং হিন্দু ধর্মের উপর আক্রমণ নিয়ে বজরং দলের বাড়ি বাড়ি প্রচার স্থানীয়দের উগ্র হিন্দুত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আজ এই হিন্দুত্ব গবেষণাগারের মূল রসদ জঙ্গলমহলের বেকার যুবকরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক শ্রেণীর হিন্দিভাষী ব্যবসায়ী, যাঁরা পুরুলিয়া তথা বলরামপুরের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এঁরাই ২০১১ সালের আগে বামেদের বিরুদ্ধে তৃণমূলকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু সেই সমর্থন ছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক, মতাদর্শগত নয়। আদতে বিজেপি বা সঙ্ঘের সঙ্গে তাদের নাড়ির টান। তাই গেরুয়া শিবির আজ তাঁদের স্বভাবিক ও প্রথম পছন্দ।

body1-copy_060718042128.jpgত্রিলোচনের বাবা ও দাদা

বলরামপুর ব্লকে বিজেপি সাতটা পঞ্চায়েত আসনে, ২০টির মধ্যে ১৭টা পঞ্চায়েত সমিতিতে এবং জেলা পরিষদের দুটি আসনেই জয়লাভ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে বিজেপির কোনও সংগঠন না থাকলেও শুধুমাত্রই আরএসএস এবং বজরং দলের সাংগঠনিক শক্তি তাদের অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বাম কর্মী-সমর্থকরা।

পয়সা, হিন্দুত্ব ও নিচু স্তরের দুর্নীতি এই তিনের মিশেলে তৃণমূল আজ জঙ্গলমহলে বেসামাল। অঞ্চলের দোর্দন্তপ্রতাপ নেতা এবং পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাত তাঁর নিজের আসনে ন'হাজারের বেশি ভোটে হেরেছেন।

তৃণমূলের জেলার নেতারাও তাই আজ মানতে বাধ্য হচ্ছেন যে, বাম ও রামের মিশেলে পুরুলিয়ার লালমাটি এখন গেরুয়া হয়ে উঠেছে।

 

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

INDRAJIT KUNDU INDRAJIT KUNDU @iindrojit

The writer is principal correspondent, India Today TV and AajTak.

Comment