অন্তত ১০ আদিবাসীর মৃত্যু: লালগড় কি আরও একটা আমলাশোল?
এই সব জায়গায় মাওবাদী নেই এবং তা হওয়ার কোনও আশঙ্কাও কম
- Total Shares
লালগড়ে যেদিন মৃত্যুর কথা জানাজানি হল সে দিন আমি লালগড়ে যাইনি। গত পরশুদিন আমি নিজে লালগড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম তৃণমূল কংগ্রেস যা করার করে ফেলেছে – মানে মৃতদের পরিবারের লেকজনকে তাদের বাড়ি-ঘর থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
বাড়ি-ঘর বলতে যা বোঝায় সে সব অবশ্য কিছুই তাদের নেই। বাড়ির ছাদ ঠিক নেই। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা মঞ্জুর হয়, কিন্তু তৃণমূল নেতারা সেই সব টাকা লুঠ করে নেয়।
গ্রামের আরও মানুষজন এসেছিলেন আমাদের দেখে। তাঁরাই আমাদের বললেন যে টাকা পেয়েছিলেন তাঁরা তবে টিপসই দিয়ে সেই টাকা তুলিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্য কাউকে দিয়ে।
আমরা কয়েকজনের বাড়িতে গেলাম যেখানে নিহতদের পরিবারের আত্মীয়স্বজন ছিলেন। তাঁরা পুরো ঘটনার কথা জানালেন যে কী ভাবে অসুস্থ হয়েছিলেন, তাঁরা খাননি।
অনাহার (উপস্থাপনামূলক ছবি, সৌজন্য: রয়টার্স)
আমি জিজ্ঞাসা করলাম অসুস্থ হতে কাউকে তাঁরা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন কিনা। সেখান থেকে কাছাকাছি হাসপাতাল বলতে লালগড়, আমরা যেখানে কথা বলছিলাম সেখান থেকে লালগড় অন্তত ২০ কিলোমিটার দূরে। হাসপাতেলর ব্যাপারে তাঁরা খুব একটা অবগতও নন সেই গ্রামের মানুষজন। তা ছাড়া যাবেনই বা কী ভাবে? এই সব জায়গায় কেউ অসুস্থ হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। রাস্তাই তো নেই!
আমরা জানতে চাইলাম সমস্যা কী। ওঁরা বললেন, “চাল-ডাল যা আসে পাচ্ছি কিন্তু আর কিছু তো পাচ্ছি না। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা জল ও রাস্তা।” জলও নেই, রাস্তাও নেই। অন্য একটি জায়গায় লোকজন বললেন কিছুই ব্যবস্থা নেই, তাঁরা নিদারুণ পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
সার্বিক ভাবে বলা যায়, এই যে উন্নয়ন, খেলা, মেলা, উৎসব এত কিছু হচ্ছে তখন পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশ অন্ধকারে ডুবে আছে। বাস্তবিক অর্থেই অন্ধকারে ডুবে আছে, অর্থাৎ বর্তমান যুগের কোনও জায়গায় সঙ্গে এই জায়গার কোনও তুলনাই চলে না। কোনও ব্যবস্থা নেই, মানুষের নিরাপত্তা নেই, জীবের নিরাপত্তা নেই, সরকারের কোনও অস্তিত্বই চোখে পড়ল না। খুবই দুর্ভাগ্যজনক বিষয়।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁদের বাড়ির লোকজন বললেন যে আরও দু’জন কয়েক দিন আগে মারা গেছেন। অর্থাৎ মোট ন’জনের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের মনে হচ্ছে অনাহার, অপুষ্টি ও বিনা চিকিৎসায় অন্তত দশ জন মারা গেছেন। তবে তাঁদের কারও ডেথ সার্টিফিকেটেই অনাহারে মৃত্যুর কথা লেখা থাকবে না।
ওই গ্রামে যাওয়ার পথেও দেখেছি দু’পাশের মানুষজনের হতদরিদ্র অবস্থা। উন্নয়নের লেসমাত্র নেই, রাস্তাঘাটের অবস্থাও ঠিক নেই, সোজা কথায় এ হল আরও একটা আমলাশোল। তখনও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন কিছু ঘটেনি, এই ঘটনাতেও মুখ্যমন্ত্রী বলছেন কিছু ঘটেনি।
অনাহার (উপস্থাপনামূলক ছবি, সৌজন্য: রয়টার্স)
তবে আগে যাই ঘটে থাকুক, আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি এই সব জায়গায় কোনও মাওবাদী গোষ্ঠী নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে তা হওয়ার কোনও সম্ভাবনাও তৈরি হবে না। কারণ আগে যারা মাওবাদী বলে পরিচিত ছিল এখন তারা সকলেই তৃণমূল হয়ে গেছে, অন্তত ৯৯ শতাংশ।
ওই পুরোনো মাওবাদীদের ধরে তৃণমূলের নেতাদের একাংশ সবকিছু হরণ করেছে – সরকারি সম্পদ থেকে শুরু করে সরকারি অর্থ, সরকারি পরিষেবা – সব কিছু। সাধারণ মানুষকে আবার দূরে ঠেলে দিচ্ছে। য়েহেতু সাধারণ মানুষকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে তাতে আগামী দিনে পরিস্থিতি আবার খারাপ হবে।
তবে আমার ধারণা, মাওবাদীদের সেই সুযোগ হবে না। কারণ আমরা মানুষকে বোঝাতে পারব যে মাওবাদী কোনও সমাধান নয়, তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে যেতে হলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে যেতে হবে।
তৃণমূল কংগ্রেস চেষ্টা করছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ভেঙে দেওয়ার। যদি তারা তা করতে পারে তা হলে হয়তো মাওবাদী সমস্যা হবে, কিন্তু যদি তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে দিতে না পারে তা হলে মাওবাদীর কোনও সম্ভাবনা আমি আজকেও দেখছি না, আগামী দিনেও দেখছি না।