নিজের খেলা কি শুরু করলেন মুকুল রায়?
পুরবোর্ড ও পঞ্চায়েতের সদস্য ভাঙিয়ে তৃণমূলের করে দিয়েছেন মুকুল রায়
- Total Shares
সৌমিত্র খান কে? প্রশ্ন করলে এক কথায় উত্তর দিতে পারবেন এমন লোক এ রাজ্যের বিষ্ণুপুর ছাড়া অন্য কোনও জায়গার মানুষ দিতে পারবেন কিনা ঘোর সন্দেহ রয়েছে। বিষ্ণুপুরের এই তৃণমূল সাংসদের তেমন পরিচিতি নেই তাঁর এলাকার বাইরে। সেই সাংসদ বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় স্থানীয় প্রায় সবক’টি সংবাদপত্রই খবরটি করেছে, অনেকে তো প্রথমপাতায় বিশাল করে। প্রতিপাদ্য হল, দুই সাংসদকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে তৃমমূল কংগ্রেস। তবে ওই দুই সাংসদের কাউকেই সাংসদ পদ ছাড়তে বলা হয়নি।
যে সাংসদের কোনও গুরুত্ব নেই দলের ভিতর-বাইরে কোথাও, তাঁর দলবদল নিয়ে এত হইচই কেন? তার কারণ একটাই – মুকুল রায় বলেছেন তৃণমূলের অনেকেই বিজেপিতে যোগ দিতে চাইছেন।
দিল্লিতে গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিলেন বিষ্ণুপুরের তৃণমূল সাংসদ সৌমিত্র খান। (ছবি: পিটিআই)
তা হলে কারা, মানে কোন ছ’জন তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিতে চলেছেন? ছ’টি নাম বলে দেওয়া যায়, তবে মিলবে কিনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। সৌমিত্র খানও যে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন সেই কথাই বা কে আঁচ করতে পেরেছিলেন? বিজেপিতে যোগ দিয়ে তিনি যে সব কথা বলেছেন সে সব রুটিন কথা। তাঁর বহিষ্কারের পরে তৃণমূল যে সব কথা বলেছে সে সবও রুটিন কথা। আসল কথাটা বলেছেন মুকুল রায় -- ছ’জন তৃণমূল সাংসদ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
এখনও পর্যন্ত অনেকেই তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়েছেন, তার চেয়ে বেশি নেতা যোগ দিয়েছেন। সে সব নিয়ে দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোটেই চিন্তিত নন। কারণ তিনি জানেন যে তৃণমূল কংগ্রেস কোনও দল নয়, তাই এই দলের ভোট চাওয়ার কোনও কারণও নেই – তৃণমূল কংগ্রেস হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং লোকে ভোট দেয় তাঁকে দেখে, তাঁর প্রতীকে।
যাঁরা পরিবর্তনের পরে পরিবর্তনের বিপুল ঝড়েও মন বদলাননি, প্রার্থী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতীকের বিরুদ্ধে, তাঁদের কী হয়েছে?
শুধু ২০১৩ সালের নির্বাচনের পরের কথা ভাবুন। ২০১১ সালে পরিবর্তনের পরে ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে বহু জায়গাতেই আসন পায়নি তৃণমূল কংগ্রেস। এমন অনেক ছোট পঞ্চায়েত ও পুরসভা ছিল যেখানে তৃণমূল কোনও রকমে ‘খাতা খুলতে’ পেরেছিল। মুখগুলো একই রয়ে গেল, শুধু সেই সব পুর ও পঞ্চায়েত বোর্ডের প্রতীকগুলো বদলে যেতে লাগল। যাঁরা নির্বাচনে জিতে বিজয়োৎসব পালন করলেন, বোর্ড গঠন করলেন, মাস খানেক পরেই রাজ্যের উন্নয়ন দেখে মুগ্ধ হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়ে ফেললেন। বোর্ডের প্রতীক বদলের কারিগরটির নাম হল মুকুল রায়। তিনি দল ছাড়ারল পরেও অবশ্য সেই ট্র্যাডিশন বদল করেনি তৃণমূল কংগ্রেস।
বিজেপিতে যোগ দিয়ে দু’একবার মুকুল রায় মুখ খুলেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নাম না করেও তাঁকে গদ্দার বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর যদি বিন্দুমাত্র ক্ষতি আজ পর্যন্ত হয়ে থাকে তা হলে সেটি হল মুকুল রায়ের দল ছেড়ে যাওয়া। অনেকে বলছেন ত্রিপুরায় বিজেপির জয়ের নেপথ্য সামান্য হলেও হাতযশ রয়েছে মুকুল রায়ের। ওখানে তিনিই তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠন তৈরি করছিলেন।
তৃণমূল কংগ্রেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন মুকুল রায়। (ছবি/ফাইল: পিটিআই)
তৃণমূল কংগ্রেসকে হাতের তালুর মতো চিনতেন মুকুল রায়। ঠান্ডা মাথার নেতা। কিন্তু দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন তাঁর ভাইপো অভিষেককে তুলে ধরতে শুরু করলেন তখন থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন মুকুল রায়। তারপরে নারদের ভিডিয়ো প্রকাশ এবং সেখানে দেখা গেল মুকুল রায়কে। সিবিআইয়ের জেরা। তবে নিজে হাতে টাকা নিতে দেখা যায়নি তাঁকে।
জননেতা নন মুকুল। সাংসদ হয়েছেন রাজ্যসভার। তা সত্ত্বেও তাঁকে দলে নিল বিজেপি। সাধারণ সদস্য হিসাবে, সেখান থেকে একেবারে এ রাজ্যে ভোটের দায়িত্বে। মুকুল রায় নিজের মতো কাজ করে যান, তাঁর গতিবিধি দলের রাজ্য সভাপতি জানেন না বলে দলের অন্দরে গুঞ্জন। তবে বিজেপির শীর্ষ নেতারা তা নিয়ে চিন্তিত নন। তাঁরা এ রাজ্য থেকে আসন চান, লোকসভা ভোটে আসন।
এ রাজ্যে বিজেপি-বিজেপি হাওয়া উঠছিল, তবে রথযাত্রা স্থগিত হতেই বিজেপি নেতাদের আর কোথা্ও দেখা যাচ্ছে না। তাঁদের হাতে একটাই তির ছিল, সেটা ফস্কালে কী হবে তা নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন না এবং এখনও নন কোনও নেতাই। ঝিমিয়ে পড়া বাজারে আচমকাই দিল্লিতে গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিলেন তৃণমূলের সাংসদ।
তিনি কি সাংসদপদ ছেড়ে দেবেন? ছেড়ে দিলেও উপনির্বাচন হবে না, কারণ সামনেই নির্বাচন। এই অবস্থায় তাই লোকসভা ভোটের আগে অন্তত অ্যাসিড টেস্ট দিতে হবে না বিজেপিকে। তা ছাড়া তিনি সাংসদপদ ছাড়বেনই বা কেন? মুকুল রায় জবাব দিয়েছেন সৌমিত্রর হয়ে: অন্য দলের একের পর এক জনপ্রতিনিধি যখন তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন তাঁরা তো তখন ইস্তফা দেননি! মুকুল রায় এ কথা সবচেয়ে ভালো জানেন।
বিজেপিতে সৌমিত্র খান যোগ দেওয়ার পরে, সাংবাদিক বৈঠক করলেন। তা শেষ হওয়ার পরে তড়িঘড়ি পাল্টা সাংবাদিক বৈঠক ডেকে সৌমিত্র খানকে বহিষ্কার করল তৃণমূল কংগ্রেস। একই সঙ্গে বহিষ্কার করা হল বোলপুরের সাংসদ অনুপম হাজরাকেও, দলবিরোধী কাজের অভিযোগে।
...for an independent academic mind ...from today onwards, ...more space to breathe ...more space to think/place opinion rationally... ...& more time for my incomplete academic works...!!! ❤???? pic.twitter.com/q9ED9EzyLs
— Anupam Hazra (Dr. Anupam Hazra) (@tweetanupam) 9 January 2019
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে দিয়েছে, তা হলে এ বার কি বিজেপিতেই যোগ দিচ্ছেন অনুপমও? দার্শনিকের মতো উত্তর দিয়েছেন অনুপম – তিনি রাজনীতি আর করবেন কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন।
...politics has never been a compulsion but a choice for me...!!! ????
— Anupam Hazra (Dr. Anupam Hazra) (@tweetanupam) 11 January 2019
দল বদল করে রাজ্যের শাসক দলে যোগ দেওয়া আর শাসক ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেওয়ার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে সেটা দেখিয়ে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। মানস ভুঁইয়া কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ হয়েছে। সৌমিত্র থান তৃমমূল থেকে বিজেপিরতে যোগ দেওয়ায় তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
লোকসভা ভোটে এ রাজ্য থেকে বিজেপি ২২টি আসন পাবে নাকি তৃণমূল কংগ্রেস ৪২টির মধ্যে ৪২টি আসনই পাবে সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব নয় ভোটের ফল প্রকাশের আগে। কিন্তু ঠিক সময়ে মুকুল রায় দেখিয়ে দিলেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ব্যবহার না করেও তিনি দল ভাঙাতে পারেন।
শোনা যায় এ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ ছিল মুকুল রায়ের হাতে। প্রশাসনও অনেকটা তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাই পুলিশ ও প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক এখনও থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ বার লোকসভা ভোটে যদি প্রাক্তন আমলা বা পুলিশকর্তাকে বিজেপির চিহ্ন নিয়ে এ রাজ্যের কোনও আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখা যায় তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মুকুল রায় এখন ব্যস্ত সংখ্যার হিসাব নিয়ে। রাজ্যের কোন লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত কোন বিধানসভা কেন্দ্রের জনবিন্যাস কী এবং সেখানে ভোটের নীতি কী হতে পারে সে সব নিয়ে গবেষণা করছেন মুকুল রায়। তিনি জানেন এ রাজ্যে বিজেপির কোনও মুখ নেই, জননেতাও নেই। তাই বিজেপি এ রাজ্যে ভালো ফল করলে তার অনেকটা কৃতিত্বই তিনি পাবেন যা তাঁকে ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটে অনেকটা এগিয়ে দেবে।