মুকুল রায় এখন বিজেপির ঘর গোছাচ্ছেন নাকি তৃণমূলের ঘর ভাঙাচ্ছেন?
বিবৃতির রাজনীতি পছন্দ করেন না, বিজেপির সংগঠন মজবুত করে দেখাতে চান মুকুল
- Total Shares
শুরুটা হয়েছিল সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়, যখন উপনির্বাচনে জিতে রাজ্য বিধানসভায় তৃণমূল কংগ্রেস কোনওক্রমে ৩০টি আসন ছুঁয়ে বিরোধী দলের তকমাটি বজায় রাখতে পেরেছে।
২০০৬-০৭ থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে আন্দোলন, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে দু’টি জেলা পরিষদে জয়। তখন পঞ্চায়েতের রং বদল করা সম্ভব হয়নি ঠিকই, তবে সরকারের কাজে যাঁরা বিরক্ত এবং সরকারে থেকেও যাঁরা বিক্ষুব্ধ, তাদের একজোট করতে শুরু করে দেয় তৃণমূল কংগ্রেস। ব্যক্তিগত ভাবে এই কাজটি করতেন মুকুল রায় নিজে। এর সুফল তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল।
এক সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে দল ভাঙিয়েছেন মুকুল রায়। (ছবি: পিটিআই/ফাইল)
বিরোধী ও বিক্ষু্ব্ধদের তালিকায় অতিবাম রাজনীতিতে বিশ্বাসীরা যেমন ছিলেন তেমনি ছিলেন দক্ষিণপন্থীরাও। বহু অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও তখন সেই মেরুকরণে সামিল হন। সেই পদ্ধতিই মুকুল রায় প্রয়োগ করতে শুরু করে দিয়েছেন।
২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরে ঠিক নয়, বরং ২০১৩ সাল থেকে শুরু হল অন্য খেলা। যে সব পঞ্চায়েত তৃণমূল কংগ্রেস দখল করতে পারেনি, সেখানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তৃণমূলে যোগ দিইয়ে দেওয়া। মুকুল রায়ের এই ‘গুণ’ই তাঁর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার ইউএসপি। যদিও সরকার গড়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ভেঙে যাওয়ায় কংগ্রেস বিধায়ক ভাঙানো শুরু হয়ে যায়।
বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও ‘পদ’ পাননি মুকুল রায়, যদিও তাঁকেই পশ্চিমবঙ্গে প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মানে এ রাজ্যে প্রচার কমিটির প্রধান হলেন মুকুল রায়। দায়িত্ব কতটা? একটা কথাতেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে – ২০১৪ সালের নির্বাচনে সারা দেশের ক্ষেত্রে এই দায়িত্বে ছিলেন নরেন্দ্র মোদী।
অর্থাৎ মুকুল রায়কেই পশ্চিমবঙ্গের জন্য বাজি ধরেছে বিজেপি।
মুকুল রায়ই এখন বিজেপির বাজি। (ছবি: পিটিআই/ফাইল)
বিজেপিতে যোগ দেওয়া ইস্তক মুকুল রায়ের কোনও কাজকর্ম চোখে পড়েনি সাধারণ লোকের। তবে ভোট যত এগিয়ে আসছে ততই তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়াচ্ছেন মু কুল রায়। তৃণমূল স্তরের নেতানেত্রীদের পাশাপাশি এই তালিকায় রয়েছেন তৃণমূলের একজন সাংসদ এবং বীরভূমের দাপুটে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের নিকট আত্মীয়। মানে তৃণমূলের ঘর যে তিনি ভাঙছেন, সে কথা বুঝিয়ে দিচ্ছেন মুকুল রায়। বিবৃতির রাজনীতি তিনি পছন্দ করেন না, তিনি বিজেপির সংগঠন মজবুত করে দেখাতে চান।
এ রাজ্যে এখনও পর্যন্ত বিজেপির কোনও মুখ নেই, সে ভাবে কোনও আন্দোলনও কোনও দিন করেনি বিজেপি। যে ভাবে আন্দোলন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান তেমন আন্দোলন করার মতো কোনও নেতাও নেই বিজেপিতে, সংগঠনও নেই। রথযাত্রা, যা বিজেপির ভাষায় গণতন্ত্র বাঁচাও যাত্রা, তা আটকে গেছে আদালতেই। তাই এ রাজ্যে আসন পেতে তাদের একমাত্র ভরসা জনসমর্থন।
শুধু জনসমর্থনের উপরে ভিত্তি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জননেত্রীর মোকাবিলা করা যে সম্ভব নয়, সে কথা বিলক্ষণ জানেন অমিত শাহের মতো বিজেপির দক্ষ নেতারা। এ রাজ্যে এমন কোনও আসন এখনও নেই যেখানে প্রার্থী হয়ে নিশ্চিত ভাবে জয় আশা করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং। তাই সংগঠন মজবুত করার ব্যাপারে মুকুল রায়ের উপরেই ভরসা করছে বিজেপি।
এ রাজ্যে ভোটের ধরণ দেখে ভোট-পণ্ডিতরা মনে করছেন, বামেদের ভোট আসছিল বিজেপির দিকে। এখন তাঁরা মনে করছেন, কংগ্রেসের ভোটও পেতে শুরু করেছে বিজেপি। কিন্তু এই তিন ভোট একদিকে এলেও তৃণমূলকে হারানো যাবে না। তাই এখন তৃণমূলকে ভাঙাতে চাইছে বিজেপি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায কি এখন চিন্তিত? (ছবি: পিটিআই/ফাইল)
মুকুল রায় তাঁর কাজ যে অনেক আগে থেকেই শুরু করে দিয়েছেন, তা এখন বোঝা যাচ্ছে। প্রশ্ন হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি কি ভয় পাওয়াতে পারছেন?
২০০৮ সাল থেকে সরকারের বিরুদ্ধে থাকা লোকজনকে এক জোট করা শুরু করেছিলেন মুকুল রায়। তৃণমূল কংগ্রেসে তাঁর জনসংযোগই ছিল সবচেয়ে ভালো, বস্তুত তৃণমূল কংগ্রেসে তিনিই এই কাজ করতেন বলে ব্লক স্তরের নেতাদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ এতটাই ছিল যে তিনি তাঁদের নামে চিনতেন। এখনও যদি তাঁর সেই যোগাযোগ থেকে থাকে, তা হলে সেটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে।
২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পরে যে পঞ্চায়েতেও বিপুল ভাবে জয়ী হয়েছিল। যে সব আসনে তারা জয়ী হতে পারেনি সেই সব আসনে জয়ীদের তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ানোর ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা ছিল মুকুল রায়ের। তিনি এখন বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় এবং একই কাজ শুরু করে দেওয়ায় কিছুটা হলেও ভাবিত হতে পারেন তৃণমূলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় – এখন তিনি বিজেপি গড়তে ভাঙাচ্ছেন তৃণমূলকেই।