উন্নয়নের পাশাপাশি সশস্ত্র লড়াই, কার্যকর না করতে পারলে মাওবাদী সন্ত্রাস ঠেকানো যাবে না
মাওবাদী এলাকায় সাধারণ ভোটারদের ভয় দূর করা যায়নি, হিংসাত্মক হামলাও পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি
- Total Shares
"সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য ও অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম আর ছোট ছোট নির্মাণ। যা বিকল্প গড়ার ক্ষেত্রে নতুন দিক খুলে দেবে।" - প্রায় তিন দশক আগে ছত্তীশগড়ে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন শ্রমিক নেতা শঙ্কর গুহনিয়োগী। ছত্তিসগড় খনি শ্রমিক সঙ্ঘের এই নেতার আন্দোলন থেকে এই কথাগুলোর ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল সংঘর্ষ ও নির্মাণের তত্ত্ব।
১৯৮৩ সালে ছত্তীসগড়ের দল্লি-রাজহরায় গড়ে উঠেছিল শহিদ হাসপাতাল। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য একদিকে সংগ্রাম অন্যদিকে শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নৈতিক মানের উন্নতিতে ছোট ছোট নির্মাণ। শঙ্কর গুহ নিয়োগী ভেবেছিলেন শ্রমিক ও তাদের পরিবারের জন্য স্কুল, হাসপাতালের মতো ছোট ছোট নির্মাণ যা বৃহত্তর সংগ্রামকে পুষ্ট করবে।
১৯৭৭ সালে ছত্তীশগড় শ্রমিক সঙ্ঘের আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর তৎকালীন জনতা সরকারের পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। পুলিশের গুলিতে ১১জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তাঁদের নামেই গড়ে উঠেছিল এই শহিদ হাসপাতাল। শ্রমিকদের স্বেচ্ছাশ্রম ও অর্থেই এই হাসপাতালের পথ চলা শুরু হয়। এর পাশাপাশি শ্রমিক মহল্লায় স্কুল তৈরি করা এবং মদ্যপান বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিক পরিবারের নারীদেরও সংগঠিত করে সংঘর্ষ ও নির্মাণের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন গুহনিয়োগী।
শঙ্কর গুহনিয়োগী [সৌজন্য: লেখক]
নয়ের দশকে আততায়ীদের গুলিতে নিহত হন শঙ্কর। নিহত শ্রমিক নেতার সমর্থকদের অভিযোগ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের একাংশের রোষে পড়েই খুন হয়েছিলেন শঙ্কর গুহনিয়োগী। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই মাপের নেতা উঠে না আসায় ভারতের শ্রমিক ও গরিব মানুষের আন্দোলনের এক বিকল্প ধারাও অবধারিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
জীবিতকালেই মাওবাদী আন্দোলনের কড়া সমালোচক ছিলেন শঙ্কর। তাঁর মত ছিল, ভারতের প্রত্যন্ত পিছিয়ে পড়া এবং দুর্গম অঞ্চলে মাওবাদী রাজনীতি কিছুটা সাফল্য পেলেও ভারতে গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না এই রাজনীতি।
আজ ছত্তীশগড়ে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে শঙ্কর গুহনিয়োগীর সংঘর্ষ ও নির্মাণের ভূমিকা প্রায় বিস্মৃত। ছত্তিসগড়ের দন্তেওয়াড়া ও বস্তার অঞ্চল এখন মাওবাদীদের হিংসাত্মক রাজনীতি বনাম রাষ্ট্র শক্তির দ্বন্দ্বের কারণেই সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে।
চলতি মাসেই ছত্তীশগড়ে বিধানসভা নির্বাচন হবে। প্রথম পর্যায়ে রাজ্যের মাওবাদী অধ্যুষিত আটটি জেলার ১৮টি আসনে ভোট হবে। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই জেলাগুলির ৫৩টি বুথে কোনও ভোট পড়েনি। বহু বুথে মাত্র দু' থেকে তিনজন ভোটার এসে ভোট দিয়েছিলেন। ভোটদানের হার বাড়াতে একমাত্র ছত্তীশগড়েই ভ্রাম্যমান বুথের অস্তিত্ব দেখা যায়। মাওবাদী এলাকায় নির্বিঘ্নে ভোটদান করতে বড় রাস্তার পাশে পাশে ভ্রাম্যমান ভোটগ্রহণ কেন্দ্র তৈরি করে নির্বাচন কমিশন।
তা সত্ত্বেও, মাওবাদী এলাকায় যেমন সাধারণ ভোটারদের ভয় দূর করা যায়নি তেমনই হিংসাত্মক হামলাও পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি। দু'দিন আগেই ছত্তিশগড়ে মাওবাদী হামলায় দূরদর্শনের এক চিত্র সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ভীতি তৈরি করে ভোটদানের হার কমাতেই এই হামলা চালিয়েছে মাওবাদীরা।
নির্বাচন এলে নির্বাচন কমিশনের তৎপরতায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়। কিন্তু তাতে ভোটারদের ভয় কাটে না। কারণ নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে বাড়তি নিরাপত্তা রক্ষীরা অঞ্চল ছেড়ে চলে যান। তখন মাওবাদীদের আক্রোশ থেকে কে বাঁচাবে এই চিন্তাতেই ভোট গ্রহণ কেন্দ্র থেকে দূরে থাকতে চান ভোটাররা।
যে কারণে ছত্তিশগড়ে মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় ভোটারদের আঙুলে কালির ছাপ দেওয়ার নিয়ম শিথিল করার প্রস্তাব জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। কমিশন এই প্রস্তাবের কথা কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রককে জানিয়েছেন। অতীতে নির্বাচনের পর আঙুলে কালির ছাপ থাকায় অনেক ভোটারকেই মাওবাদীদের হামলার মুখে পড়তে হয়েছে। সেই কারণে এই নিয়ম শিথিল করার প্রস্তাব উঠেছে।
মাওবাদীদের ভয়ে তটস্থ স্থানীয় ভোটাররা [ছবি: এপি]
গত কয়েক দশক ধরেই দেশের বিভিন্ন রাজ্যে মাওবাদী সন্ত্রাসের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেই তালিকায় সবচেয়ে উপরে নাম রয়েছে ছত্তীশগড়ে। সাতের দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলন প্রতিহত করতে একদিকে উন্নয়ন ও অন্যদিকে সশস্ত্র অভিযানের কৌশল নিয়েছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য ছিল দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় অনুন্নয়নের সুযোগে নকশালপন্থীরা তাদের প্রভাব বাড়াতে পাচ্ছে। এই প্রভাব ঠেকাতে ওই সমস্ত অঞ্চলে উন্নয়নের কাজ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নিরাপত্তাবাসিনী দিয়ে নকশালদের সশস্ত্র আন্দোলনের মোকাবিলা করতে হবে।
আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও কেন্দ্রীয় সরকার ও মাওবাদী অধ্যুষিত রাজ্যগুলোর সরকার একই কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষগুলো জীবন ও জীবিকার তেমন কোনও উন্নতি হয়নি। ফলে, কিছু কয়েকটি জায়গায় পিছিয়ে পড়া হতদরিদ্র মানুষজন আজও মাওবাদী রাজনীতির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন।
তাই মনে হয় কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারকেই উন্নয়নের কাজে আরও আন্তরিক হতে হবে। বৈষম্যের শিকার হওয়া মানুষজন যাতে সরকারকে পাশে পায় সেই রাস্তা খুঁজে বার করতে হবে। তবেই এই ধ্বংসাত্মক ও হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির মোকাবিলা করা যাবে।