পঞ্চায়েতে কী ভাবে এল পরিবারতন্ত্র, কেন হানাহানি
প্রথমে ছিল প্রভাবশালীদের সন্ধান, পরে তা থেকেই শুরু পরিরবারতন্ত্র
- Total Shares
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। এই গণতন্ত্রের একটি প্রধান বিষয় রাজনীতি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজনীতিতে উচ্চকোটিদেরই প্রাধান্য ছিল। হাতেগোনা কয়েকজন ছিলেন নিম্নকোটির প্রতিনিধি। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকার প্রথম দিকে এই উচ্চকোটির প্রতিনিধিদের ঘিরেই আবর্তিত হত রাজনীতি। পরবর্তী কালে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে আঞ্চলিক শক্তিগুলির উত্থান হতে থাকে। স্বাধীনতার লগ্নে অবশ্য ব্যতিক্রমের তালিকায় ছিল দক্ষিণ ভারত। সেখানে কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে যে রাজনৈতিক দলগুলি, তার নেতৃস্থানীয় ছিলেন নিম্নকোটিরাই। রাজনীতিতে একেবারে প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের সম্পর্ক ছিল শুধু ভোট দেওয়ার। যেহেতু রাজনীতিতে উচ্চকোটির লোকেরা ছড়ি ঘোরাতেন তাই বংশ পরম্পরায় দলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকতেন নেতানেত্রীদের নিকটাত্মীয়রা। ভারতীয় রাজনীতিতে বাবা-ছেলে, দাদা-ভাই, কাকা-ভাইপো এই চক্রে বাঁধা ছিল রাজনীতির রাশ। এ ক্ষেত্রে উচ্চকোটির সঙ্গে নিম্নকোটির সঙ্গে তেমন কোনও পার্থক্য নেই। এই তালিকায় নেহরু বংশ যেমন রেয়েছে, তেমনই রয়েছে মুলায়ম সিং যাদব, লালুপ্রসাদ যাদব ও করুণানিধিরা।
ধীরে ধীরে দেশে যখন অর্থনীতি শিল্পনীতি সব কিছুরই নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছ রাজনীতি, তখন থেকেই পরিবারতন্ত্রের বৃত্তে ক্ষমতা ধরে রাখার উদাহরণও বেড়েছে। একমাত্র খুব হীনবল রাজনৈতিক দল ছাড়া আর সব দলেই এই পরিবারতন্ত্রের উদাহরণ রয়েছে। দেশে গণতন্ত্র থাকার ফলে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কার হাতে থাকবে, তা নির্ধারিত হয় ভোটে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ভোটের ময়দানে এবং শাসকদসলের মন্ত্রিসভায় এখনও পরিবারতন্ত্রেরই প্রাধান্য। লোকসভার, ভোট বিধানসভার ভোট – সব ভোটেই প্রার্থীতালিকায় চোখ বোলালে দেখা যাবে পরিবারতন্ত্রের মহিমা। দেশে স্থানীয় প্রশাসনিক স্তরে নির্বাচন চালু হওয়ার পরে সেখানেও এই পরিবারতন্ত্রের পা শক্ত হয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন, পুরসভা নির্বাচন -- সব ক্ষেত্রেই পরিবারতন্ত্রের ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। লোকসভা ও বিধানসভার তুলনায় পঞ্চায়েত ও পুরসভা নির্বাচনে যেহেতু প্রার্থীর সংখ্যা ও আসন সংখ্যা অনেক বেশি, তাই এক পরিবার থেকে প্রার্থী হওয়ার সংখ্যাটাও অনেক বেশি। পঞ্চায়েত ও পুরসভা নির্বাচনে যাঁরা জেতেন, তাঁরা একেবারে তৃণমূল স্তরে কাজ করেন। একজন পঞ্চায়েত সদস্য বা একজন পুরসভার কাউন্সিলরের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যতটা যোগাযোগ থাকে, একজন সাংসদ, একজন বিধায়ক অথবা মন্ত্রীর সঙ্গে ততটা থাকে না। পঞ্চায়েত ও পুরসভার প্রতিনিধরা একজন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চাওয়াপাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি প্রকল্পগুলি পৌঁছে দেওযার কাজ করেন।
ভারতীয় রাজনীতিতে বাবা-ছেলে, দাদা-ভাই, কাকা-ভাইপো এই চক্রে বাঁধা ছিল রাজনীতির রাশ
ফলে এই দুই ক্ষেত্রেই এলাকায় পরিচিতি বা এলাকায় ভাবমূর্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই পথেই পরিবারতন্ত্রের প্রবেশ। দাস-ঘোষ-বিশ্বাস অববা মুখার্জি – পদবী যাই হোক না কেন, যে পরিবারের স্থানীয় এলাকায় দাপট বেশি, তাদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে বাধ্য হয় রাজনৈতিক দলগুলি।
এ ক্ষেত্রে যদি পশ্চিমবঙ্গের দিকে আমরা তাকাই, তা হলে দেখা যাবে, ১৯৭৮ সালে যখন প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল, তখন বাম-ডান কোনও দলেরই সব আসনে দলীয় প্রার্থী দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। তাই বামপন্থী দলগুলি স্থানীয়স্তরে প্রভাবশালী শিক্ষক, ডাক্তার, বড় চাকরিজীবীদের প্রার্থী তালিকায় প্রাধান্য দিয়েছিল। এই প্রাধান্য দিতে গিয়ে একই পরিবার থেকে প্রার্থী দেওয়ার সংখ্যাটাও বেড়েছিল। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের বিভিন্ন প্রকল্পে আর্থিক অনুদান বেড়েছে। এখন জেলাপরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রামপঞ্চায়েতগুলিতে বিভিন্ন প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। এর সঙ্গে পাইয়ে দেওয়ার বিষয়টি সরাসরি জড়িত। ফলে জেলাপরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রামপঞ্চায়েতের সদস্যদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে আর এই সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছ প্রভাব-প্রতিপত্তি। ফলে এই প্রভাব-প্রতিপত্তি পরিবারের মধ্যে ধরে রাখতে পারলে তা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামবাংলায় একই পরিবারের দুই জা, দুই ভাই, বাবা-ছেলে অথবা কাকা-ভাইপোর মধ্যে বিভিন্ন দলের প্রার্থী হওয়ার সংখ্যাও অেনেক বেড়েছ। পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের যেকোনও গ্রামে গেলেই এই রকম ভূরি ভহূরি উদাহরণ চোখে পড়বে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে সর্বত্রই যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকে, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই রাজনৈতিক লড়াই হিংসার আকার নেয়। অনেক সময় আবার এর মধ্যে রাজনীতি থাকে এমনটাও নয়।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজনৈতিকর সন্ত্রাসের দিক থেকে প্রথম স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। তাই যে কোনও নির্বাচন এলেই রক্তাক্ত হয় পশ্চিমবঙ্গ। এরই মাঝে লুকিযে থাকে পারিবারিক বিরোধও। অনেক সময়ই জমি নিয়ে বিবাদ, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ, প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখার বিবাদ থেকেও নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রবণতা বাধে। সেক্ষেত্রে এই সব পারিবিরক বিবাদের জেরে হওয়া হিংসাও রাজনৈতিক হিংসার মোড়ক পেয়ে যায়।
একমাত্র খুব হীনবল রাজনৈতিক দল ছাড়া আর সব দলেই এই পরিবারতন্ত্রের উদাহরণ রয়েছে
তৃণমূলস্তরে গিয়ে দেখলে দেখা যাবে, অনেক ক্ষেত্রেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসার পিছনে গ্রাম্য বিবাদ একটি বড় কারণ। পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরিবারতন্ত্রের প্রাধান্যের পিছনে আরও একটি বড় কারণ, প্রার্থী তালিকায় মহিলা সংরক্ষণ। নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যেই আসনের ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ চালু করা হয়েছে। গ্রামীণ বাংলায় যেহেতু পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্য অত্যন্ত বেশি তাই মহিলাপ্রার্থী দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্রের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। কোনও পরিবারে বড় ভাইয়ের স্ত্রী নির্বাচনে দাঁড়ালে ছোট ভাইও চেষ্টা করে তাঁর স্ত্রীকে প্রার্থী করতে। আর এখানেই গজিয়ে ওঠে বিরোধের বীজ। তবে আবার বলছি, সর্বত্রই যে এই বিরোধ দেখা দেয়, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতাও থাকে। আর এই ছবিটা পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে একটা অন্য মাত্রা যোগ করে। অনেক গ্রামে গেলেই চোখে পড়বে ভোরে ঘুম থেকে উঠে দুই জা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হেঁসেল সামলাচ্ছেন, একে অপরকে সাহায্য করছেন আবার বেলা গড়াতেই দুই যুযুধান দলের প্রার্থী হিসাবে একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারে বেরোচ্ছেন।
একই ছবি দেখা যায় কোনও কোনও পরিবারে দুই ভাইয়ের ক্ষেত্রে। সকালে উঠে দু’জনে হয়ত পারিবারিক জমিতে হল ধরছেন, আবার কাজ শেষে পঞ্চায়েত নির্বাচনে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছেন।
ভারতের রাজনীতিতে সামাজিক বিভেদের ছবিটা খুব স্পষ্ট। হাতে গোনা কয়েকজনকে বাদ দিলে দলিত, অনগ্রসর শ্রেণী, কৃষক অথবা প্রান্তিক স্তরের মানুষের প্রাধান্য রাজনীতিতে নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে আবার পঞ্চায়েত-পুরসভার মতো প্রান্তিক স্তরের নির্বাচনে বিভেদ ও মিলনের এই ছবিটা খুবই উজ্জ্বল।

