নিয়ম বদল করলে তবেই গণতন্ত্র ফিরতে পারে নির্বাচনে
মানুষের সেবা করার সুযোগ পেতে এ রাজ্যে বারে বারেই মানুষের উপরে হামলা করেছে শাসকদল
- Total Shares
আচমকা পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণা এবং তারপরে ছন্নছাড়া বিরোধী শিবিরের হন্যে হয়ে প্রার্থী খোঁজা, প্রায় কোথাও উপযুক্ত কেন, কোনও প্রার্থীই খুঁজে না পাওয়া —এ সব দৃশ্য তারিয়ে উপভোগ করার কথা ছিল রাজ্যের শাসকদলের। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে কোথাও বিরোধী প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দিতেই তারা রাজি নয়। রাজ্যে উন্নয়নের জোয়ারের উপরে কি ভরসা নেই শাসকদলের?
বাম আমলে দেখা যেত, শাসকফ্রন্টের প্রার্থীর নাম আর প্রতীক দিয়ে দেওয়াললিখন যখন শেষ, বিরোধীরা তখনও প্রার্থী খুঁজতে ব্যস্ত। বিরোধীদের কব্জি কেটে নেওয়া ও হাত কেটে নেওয়ার মতো ঘটনাও বিরল ছিল না। কিন্তু এখন তো প্রার্থী হওয়া পর্যন্ত ধৈর্যই ধরতে পারছে না শাসকদল। মনোনয়ন জমা দেওয়া দূরে থাক, সেটি তুলতে গেলেই তারা চড়াও হচ্ছে বিরোধী দলের উপরে।
মানুষের সেবা করার সুযোগ পেতে এ রাজ্যে বারে বারেই মানুষ মেরেছে শাসকদল
মানুষের সেবা করার সুযোগ পেতে এ রাজ্যে বারে বারেই মানুষ মেরেছে শাসকদল। এ বার পঞ্চায়েত ভোটে সম্ভবত সে সব এড়াতেই বিরোধীদের ব্লক উন্নয়ন অফিসের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতে চাইছে না তারা। বিরোধী প্রার্থী না থাকলেই বিরোধ হবে না, সম্ভবত এই তত্ত্বেই পঞ্চায়েত ভোট চাইছে শাসকদল। তবে তারা নিজেদের উপরে খুব একটা ভরসা করছে, এমনটাও নয়, জনসেবার সুযোগ পেতে কোথাও কোথাও শাসকদলের মধ্যেও মারামারির খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রাজ্যে মোট গ্রামপঞ্চায়েত আসনের সংখ্যা ৪৮,৬৫০। পঞ্চায়েত সমিতির আসন ৯২১৭টি এবং জেলা পরিষদের আসন ৮২৫টি। মোট ৪৩,০৬৭টি ভোটকেন্দ্রে থাকছে ৫৮,৪৬৭টি বুথ। ভোট পরিচালনা করবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচন কমিশন। দেশের নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্যে তার যে শাখা রয়েছে, অর্থাৎ লোকসভা ও বিধানসভা ভোট যারা পরিচালনা করে তাদের সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনর কোনও সম্পর্ক নেই। এই কমিশন রাজ্যের পঞ্চায়েত ও পুরভোটের দায়িত্বে। অর্থাৎ পঞ্চায়েত ভোট রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিকের অধীনে হয় না, এই ভোট হয় রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের অধীনে।
রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটে প্রত্যেক ভোটারকে তিনটি করে ভোট দিতে হয়—গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের প্রার্থীকে নির্বাচিত জন্য। তাই কোনও পঞ্চায়েত আসনে প্রার্থী না থাকলেও বুথে ভোট হবে। সে ক্ষেত্রে অনেক গ্রামপঞ্চায়েত আসনে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে না পারলেও বুথে নিরাপত্তারক্ষী দরকার। কমিশন নিশ্চয়ই সে কথা ভেবেছেন, তাই শেষ পর্যন্ত তিনিও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্য সুপারিশ করেছেন।
গণতন্ত্রের নিয়মে ভোটের সময় প্রশাসন চলে যায় নির্বাচন কমিশনের অধীনে। কিন্তু বাস্তব হল, তাঁকে কাজ করতে হয় রাজ্য সরকারের অধীনে। আরও বড় বাস্তব হল, সরকার পরিচালিত হয় শাসকদলের মর্জিমাফিক। তাই অতি সরল ভাবে বলা যায়, কমিশনকেও কাজ করতে হয় সেই শাসকদলের অধীনেই। তাও প্রথম থেকে রাজ্যপুলিশের উপর ভরসা করলেও শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার।
মাঝেমধ্যেই বিরোধীরা রাজ্যপালের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে তাঁরা দেখাও করেছেন রাজ্যপালের ব্যাপারে নালিশ জানাতে। তবে এখনও পর্যন্ত শাসকদলের তরফে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের প্রতিটি সিদ্ধান্তকেই স্বাগত জানানো হয়েছে। বিরোধীদের কাছে এটা সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।রাজ্যে এখন পুলিশ-প্রশাসন (যারা পঞ্চায়েত ভোটের সঙ্গে যুক্ত) থাকার কথা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে, কিন্তু সংবাদপত্রে যে সব ছবি প্রকাশিত হচ্ছে, সেই সব ছবি যদি সত্যি হয়, তা হলে নির্বাচন কমিশনের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ রয়েছে।
এ রাজ্যে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ পঞ্চায়েত ভোটের যে ইতিহাস রয়েছে, তাকে আর যাই হোক সুস্থ গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি বলা যায় না। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকেও এ ব্যাপারে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তিনি নিজেও রাজ্য সরকারের পে-রোলে রয়েছেন। প্রশ্ন হল, তা হলে কী এ রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে কোনও দিন প্রকৃত ভোট হবে না? কী ভাবে তা করা সম্ভব?
ভোট হিংসা (ফাইল চিত্র)
উপায় একটা আছে। পঞ্চায়েত ভোট যে সময়ে নির্ধারিত, তার ৭-৮ মাস আগে অন্য কোনও রাজ্যের নির্বাচন কমিশনকে এ রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ করা। তিনি সবক’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে ভোটের দিনক্ষণ স্থির করবেন এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। দরকারে এ জন্য আইন সংশোধন করা যেতে পারে।
মনোনয়ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও একটি বিকল্প উপায় হতে পারে। কোনও রাজনৈতিক দল যদি মনে করে, তা হলে নির্দিষ্ট প্রার্থীর অনুমোদনসাপেক্ষে কেন্দ্রীয় অফিসে মনোনয়ন জমা দিতে পারে। তাতে প্রার্থীর মনোনয়ন পেশ করা খুব সমস্যার হবে না। প্রতিটি নির্বাচককে ভোটের দিন নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয় ঠিকই, কিন্তু মাস তিনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করলে অন্তত ভোটের সময় কেন্দ্রীয় বাহিনী পাওয়া যাবে, তাতে ভোটের দিন গণ্ডগোল অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে।
এখন যারা শাসকদলে, তা কেন্দ্রে হোক বা যে কোনও রাজ্যে, একদিন তাঁরাও বিরোধী আসনে বসবেন, এ কথা হলফ করে বলা যায়। তাই তাঁরা এই পদক্ষেপ করলে তাতে লাভ হবে গণতন্ত্রেরই।

