রামনবমী: হিন্দুত্ববাদীরা কেন পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক আগুন ছড়াচ্ছেন
আরএসএস-বিজেপি এখনও বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ঠিক ওয়াকিবহাল নয়
- Total Shares
রাজ্যের সামাজিক সংস্কৃতিকে নতুন করে সাজানোর উদ্যোগে এক গেরুয়া বিপ্লবের সূচনা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। আর, এই উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করতে রামনবমীর মিছিলকে বার্ষিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত করে ফেলেছে আরএসএস এবং বিজেপি।
তারা এখন বাঙালি হিন্দুদের হিন্দিভাষী হিন্দুত্ববাদীদের মতো গড়ে তুলতে চায়। এই লক্ষে প্রতিদিনই রাজ্য জুড়ে সঙ্ঘের নতুন নতুন শাখা (২০১৭ র শেষে আরএসসের ১,৩৫০টিরও বেশি শাখা তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে) গড়ে তোলা হচ্ছে। ধর্মের উস্কানি দিয়ে তারা প্রথমবারের জন্য পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করতে বদ্ধপরিকর। এই লড়াইয়ে তাদের প্রধান হাতিয়ার হল মুসলমানদের হুমকির বিরুদ্ধে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলা।
কিন্তু আরএসএস-বিজেপি এখনও বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ঠিক ওয়াকিবহাল নয়। তারা বুঝতে পারছে না যে বাঙালিরা আগে একজন বাঙালি, তারপর হিন্দু। একজন বাঙালি হিন্দু হতে পারেন, মুসলমান হতে পারেন, ব্রাহ্ম হতে পারেন, বৈষ্ণব হতে পারেন, বৌদ্ধ হতে পারেন আবার খ্রিস্টানও হতে পারেন। কিন্তু ধর্ম নির্বিশেষে তিনি সবার আগে একজন বাঙালি যিনি বাংলা ভাষা ও বাংলার সংস্কৃতি সম্পর্কে ভীষণ ভাবে সচেতন।
আরএসএস ও বিজেপি একটা কথা বুঝতে পারছে না যে সব বাঙালিই কিন্তু হিন্দু নন, আবার পশ্চিমবঙ্গের সব মুসলমানরাই কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আগত জেহাদি নয়।
বীরভূমে রামনবমী
গত বছর গেরুয়া শিবির যখন তলোয়ার ও ত্রিশূল হাতে রামনবমীর মিছিল করেছিল, তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও একই কথা বলেছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "ওরা বাংলার সংস্কৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়... ওরা শুধু তলোয়ার নিয়ে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াতে জানে।"
গত বছর অবশ্য কোনওরকম ঝুটঝামেলা হয়নি। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। এ বছর রামনবমীর মিছিল ঘিরে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় যাতে অন্তত দু’জনের প্রাণ গিয়েছে। মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলা ছাড়াও বেশ কয়েকটি এলাকাতে পুলিশের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন বিজেপি ও আরএসএস কর্মীরা।
গেরুয়া শিবিরের ক্ষমতা দখলের রণকৌশলটা খুব পরিষ্কার - রামের নামে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করে তোলা। এতে রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলা ব্যাপক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এরকম চলতে থাকলে রাজ্যের উন্নয়ন ধাক্কা খাবে। একই সঙ্গে বঙ্গ সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তির অস্তিত্বসঙ্কট দেখা দেবে।
বাংলার সংস্কৃতিতে শক্তির আরাধনা
যে ভাবে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে রাম পূজিত হন পশ্চিমবঙ্গে সে ভাবে তাঁর পুজো হয় না। পশ্চিমবঙ্গে রামনবমীর সময় অন্নপূর্ণা পুজোর মাধ্যমে শক্তির আরাধনা করা হয়। কয়েক কোটি বাঙালি বহু যুগ ধরে তাই করে আসছেন। বারো মাসে তেরো পার্বনের জন্য বিখ্যাত পশ্চিমবঙ্গ। তাই তো বাংলার আর্থসামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে উৎসবগুলো অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।
এই বার্ষিক উৎসবগুলো জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বহু শতাব্দী ধরেই উদযাপিত হয়ে আসছে। এই উৎসবগুলোর স্থান বাংলার অসাম্প্রদায়িক জনমানসের হৃদয়ে। পশ্চিমবঙ্গে মূলত নারী শক্তির আরাধনা করা হয়। বাংলা ভাষা ও বাংলার সংস্কৃতি পাল যুগ (৭৫০ থেকে ১১৭৪) থেকে চলে আসছে। মুঘল বা ব্রিটিশদের বহু যুগ আগে এই পালেরা প্রায় সওয়া চারশো বছর ধরে 'বঙ্গ' শাসন করেন।
তার আগে বাংলায় সংস্কৃত ভাষা চালু ছিল। গুপ্তযুগে বাংলা তো সংস্কৃত ভাষার আঁতুড় ঘর ছিল। ১০০০-১২০০ সাল নাগাদ সংস্কৃত ও মগধী-প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়। পাল রাজত্বে সাধারণের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়। সেই সময় বৌদ্ধরা তারার পুজো করতেন। তারাপীঠে তারার একটি মূর্তি ছিল, যেখানে পরবর্তীকালে মা কালীর মন্দির নির্মাণ হয়।
দার্জিলিংকে এক সময় দোরজে-লিং বলে সম্বোধন করা হত, যার মানে 'বজ্রপাতের রাজ্য'। এখন অবজারভেটরি হিলের যেখানে মহাকাল মন্দির রয়েছে সেখানে এক সময় মহাযান বৌদ্ধ মঠ ছিল। যেখান থেকে সরাসরি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। বৌদ্ধধর্মের তান্ত্রিক শাখা বজ্রযানের বিস্তার হয়েছিল বাংলায়।অতীশ নামে একজন বৌদ্ধ দার্শনিক ও ভিক্ষু তিব্বত গিয়েছিলেন, তিনি বাঙালি এবং বঙ্গে তিনি দীপঙ্কর নামে পরিচিত ছিলেন।
তিলপ বলে আর এক বৌদ্ধ ভিক্ষু অনুত্তর যোগতন্ত্র প্রচার করেন। তিনিও একজন বাঙালি ছিলেন। তিলপের ছাত্র ছিলেন নারপা যিনি একসময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তিনিও বাঙালি। এই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গজীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেই পাল যুগ থেকে এই ভাবেই বঙ্গ জুড়ে শক্তির আরাধনা হয়ে আসছে।
বৌদ্ধযুগের শেষে বৌদ্ধ ও শক্তি-সংস্কৃতির দেবদেবীদের নিয়ে তৈরি হয় দশমহাবিদ্যা।
বর্তমানে মা কালী ও মা দুর্গা পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়া বাঙালিরা বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর পুজো করে থাকেন।
।
বাংলার সংস্কৃতিকে মুছে ফেলবার চেষ্টা চলছে
বাংলা কিন্তু শুধুমাত্র নারী শক্তির আরাধনা করেই থেমে থাকেনি। দেশের মহিলাদের উন্নতিসাধনের জন্য বেশ কিছু সামাজিক সংস্কার এই বঙ্গেই শুরু হয়েছিল। রামমোহন রায় যেমন সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে আন্দোলন শুরু করেন এবং ১৮২৯ সালে আইন করে সতীদাহ প্রথা বেআইনি ঘোষিত হয়। বিদ্যাসাগর আবার বিধবাবিবাহের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন যা ১৮৫৬ সালে আইনসিদ্ধ হয়।
এ সব কিছুই বাংলার নবজাগরণের সময় হয়েছিল। যখন প্রথাগত আইনগুলোর বিরুদ্ধে একের পর এক আন্দোলন তৈরি হয়েছিল। এই নবজাগরণ সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম ও শিল্পকলাকেও অনুপ্রাণিত করেছিল।
পশ্চিমবাংলায় এখনও অনার্য দেবদেবীদের পুজোর রেওয়াজ রয়েছে। যেমন ধর্ম ঠাকুর, ষষ্ঠী, মনসা, চণ্ডী, শীতলা, বাসন্তী ও বনবিবি। নগরাঞ্চলের বনেদি পরিবারের এই দেবদেবীদের আরাধনা খুব একটা করেন না। এই দেবদেবীরা মূলত গ্রামীণ বাংলাতেই বেশি পূজিত হন। এই দেবদেবীদের অধিকাংশ নারী। এখান থেকেও আমরা বাংলার নারী শক্তি আরাধনার নিদর্শন পাই।
বাংলার এই ইতিহাস জানার পর মানুষের বিরক্তি বাড়বেই কারণ গত বছর এই বাংলার মাটিতে রামনবমীর মিছিল বের করে বিজেপি আরএসএস স্লোগান তুলেছিল, "না দুর্গা, না কালী। কেবল রাম ও বজরংবলী।"
রণকৌশলটা ঠিক কী
একটা চেষ্টা চলছে বাংলার সংস্কৃতিকে মুছে ফেলে বাঙালিদের উপর পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ দেবতাদের চাপিয়ে দেওয়ার। চেষ্টা চলেছে যাতে বাংলাকেও গো-বলয়ের ধাঁচে তৈরি করা যায়।
কিন্তু গেরুয়া শিবিরের কাছ থেকে হিন্দু ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে বাংলা শিক্ষা নিতে যাবে কেন? বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে অরবিন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে মৌলানা আজাদ অনেকেই হিন্দু ধর্মের জন্য ও দেশের নিজেদের জীবন দিয়েছেন। এ ভাবে হিন্দু ধর্মের ও জাতীয়তবাদের দোহাই দিয়ে বাংলা দখল করা যাবে না। এই কৌশল কাজে লাগবে না। বিজেপির ভোটও বাড়বে না, বরঞ্চ কমবে।
এবার সীতার অগ্নি পরীক্ষায় বসতে হবে বাংলাকে। বাংলার ঐতিহ্য এখন হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারের চ্যালেঞ্জের মুখে। এই প্রচারে অর্থের কোনও অভাব নেই।
পশ্চিমবঙ্গকে পশ্চিমবঙ্গ থাকতে হলে আর একজনকে যেন তেন প্রকারে আরএসএস ও বিজেপির উত্থান রুখতেই হবে। পাল্টা ধর্মের রাজনীতি খেলে কিন্তু লাভ হবে না।
একটা বিষয় নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বিজেপি ও আরএসএস কিন্তু চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দিয়েছে। রামায়ণের মাধ্যমে বাংলায় মহাভারতের সৃষ্টি করতে চাইছে তারা। ২০১৯ ও ২০২১ এর নির্বাচন আসছে। রাজনৈতিক হিংসা ও বিশৃঙ্খলার যথেষ্ট সম্ভাবনাও রয়েছে। চুপ করে বসে থাকার দিন শেষ। প্রত্যেককেই শয্যা ত্যাগ করে গেরুয়া শিবিরের রণকৌশল পণ্ড করতে হবে। গেরুয়ারা পশ্চিমবঙ্গকেও হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। বাংলা ও আরও দুটি দক্ষিণী রাজ্য যদি এই প্রচেষ্টা রুখতে সফল হয় তাহলে দেশের সংবিধানও সুরক্ষিত থাকবে।
আবার সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যা অতীতে বহুবার হয়ে এসেছে - ভারতের ভবিষ্যৎ বাংলার হাতে। তবে এই লড়াইটা কিন্তু সবচাইতে কঠিন।

