তেলুগু অভিনেত্রী শ্রী রেড্ডির রাজপথে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ করলেন কেন, তিনি তো উন্মাদ নন

মেয়েদের খোলামেলা পোশাকের জন্য পুরুষ আকৃষ্ট হচ্ছেন যাঁরা বলেন, তাঁদের শিক্ষার অভাব

 |  4-minute read |   14-04-2018
  • Total Shares

অষ্টাদশ শতাব্দী তো বটেই তারও আগে মেয়েদের উন্নতির দিকটা ছিল মেয়েদের ক্ষেত্রে এখনকার তুলনায় একেবারেই আলাদা। যেমন তাঁর শিক্ষা, তাঁর বিয়ের বয়স বা তিনি কোন জীবিকা বেছে নেবেন, এ সব নিয়ে একটা দীর্ঘ সময় ধরে নানা চর্চা হয়েছে। আজ এটা পরীক্ষিত সত্য যে মেয়েরা কোনও অংশে পুরুষদের চেয়ে কম নয়। মানুষের অধিকার বা সুরক্ষার কথা বলার জন্য রয়েছে মানবাধিকার কমিশন, কিন্তু তেমন ভাবে ব্যক্তি বা একজন মানুষের সার্বিক উন্নতি বা সমাজ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও এই ধরণের অন্যান্য বিষয় নিয়ে চর্চার কোনও মঞ্চ আমরা এখনও পাইনি।

আমাদের যে সব সামাজিক নিয়ম, নির্দেশিকা বা আইন আছে তার বেশির ভাগটাই মহিলাদের কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে। এই নিয়মাবলি অনুসারে যেমন পুরুষরা অনেক কিছু করতে পারেন ('ডুস'), মহিলাদের ক্ষেত্রে কিন্তু রয়েছে অনেক রকমের বাধানিষেধ ('ডোন্টস')। আমাদের সমাজ অন্যান্য বিষয়ে নেতা এগিয়ে থাকলেও নারী ও পুরুষের মধ্যে এই বৈষম্যের জায়গাটা কিন্তু এখনও একইরকমই রয়ে গেছে। আর এই ফারাকটা আমরা কেউ মুছে ফেলার কোনও চেষ্টাও করি না।

আমার মনে হয়, এই মৌলিক শিক্ষাগুলো একদম পরিবার থেকেই শুরু হওয়া উচিৎ। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে স্বাভাবিক ভাবেই পুরুষদের বাড়িতে বা বাড়ির বাইরে একটা বড় জায়গা রয়েছে কারণ তাঁরা রোজগার করেন। তাঁরা পরিবারের মাথা, কারণ পরিবারের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তিনিই নিয়ে থাকেন। যদি একজন মহিলা সিঙ্গল মাদার বা সিঙ্গল ওম্যান না হন, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু তাঁকে রোজগার না করলেও চলে বা বড় কোনও সামাজিক বা পারিবারিক সিদ্ধান্তও নিতে হয় না তাঁকে। একজন মহিলার সামাজিক অবস্থানটা এখনও খুব দুর্বল। এ ছাড়া রয়েছে আর একটা বড় ব্যাপার সেটা হল যৌনতা এবং নারী বা পুরুষের শরীর ঘিরে অযথা একটা কৌতূহল সৃষ্টি করা।

পুরো চিত্রটা যে রাতারাতি বদলে যাবে এমনটা আশা করি না আর সেটা সম্ভবও নয়। তবে আর দেরি নয় একটাই সময়। সবাইকে আরও স্বচেতন হতে হবে।

হায়দরাবাদে তেলুগু অভিনেত্রী শ্রী রেড্ডির রাজপথে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদের বিষয়টাকে অনেকেই হয়ত খুব খারাপ ভাবে দেখেছেন। কিন্তু একজন নারীর এ হেন আচরণের কারণটা ঠিক কী সেটা কী একবারও ভেবেছেন? তিনি পাগল নন। ওঁর মস্তিস্ক যথেষ্ট সজাগ, তাহলে তাঁর এই আচরণের কারণ কী হতে পারে? তাঁর হয়ত সত্যিই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল তাই সে এ ভাবে প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছিলেন। এই একই রকম ঘটনা আমরা মণিপুরেও দেখেছি যখন মনোরমার উপর অকথ্য অত্যাচারের বিরোধিতা করে ওখানকার মহিলারা নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ করেন।কার্ল জুং 'collective unconscious' কথা বলেছিলেন। এর মানে হল আমার বয়স যাই হোক না কেন আমার সমাজের যে বয়স সেটাই কিন্তু আদতে আমার বয়স, মানে আমার সংস্কৃতির বয়স যদি ৪০০ বছর হয় তাহলে আমি কিন্তু এই ৪০০ বছরের সংস্কৃতি, আচার ও আচরণকে ধারাবাহিক ভাবে বহন করে চলেছি। এটাই আমারও পরিচয়। এখানে যেই নারীরা শ্রী রেড্ডির ঘটনাকে ছিছি করছেন তাঁরা কিন্তু একবারও ভাবছেন না যে এই প্রতিবাদী নারী ঠিক কতটা দুঃখে বা কষ্টে প্রতিবাদের এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আসলে এটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কোনও সমস্যা নয় এটা একটা দর্শন।

নির্ভয়া, কামদুনি, কুশমণ্ডি বা কাশ্মীরের ঘটনাগুলো নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে এই ধরণের ঘটনা অবিরাম ঘটে চলেছে। আগে যখন একজন ৮০ বছরের বৃদ্ধ একটা সাত বা আট বছরের কোনও ছোট মেয়েকে বিয়ে করতেন, সেটা কী ওই মেয়েটিকে সযত্নে তুলে রাখার জন্য? মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাড়ায়ে তাঁদের বাড়ির লোকেরাই যেমন তার দাদা বা কোনও নিকট আত্মীয়। তাই বৃন্দাবন এত ভারী হয়ে উঠেছিল বিধবাদের ভিড়ে। কারণ স্বামী মারা যাওয়ার পর যতই মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হোক না কেন, বাড়ির পুরুষরা তো বিধবা মেয়েটির শরীরটা দেখতে পাচ্ছে, সেটাই বা কম কী? তাই পুরুষদের ক্ষুধার্থ থাবা থেকে এঁদের বাঁচাবার জন্য কাশী বা বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দেওয়া হত। আমার মনে হয়, নারীদের নিয়ে যে এত গবেষণা হচ্ছে, এখন পুরুষদের নিয়ে কিছুটা গবেষণা করা উচিৎ, পুরুষদের মানবিকতা কেন জাগে না বা কবে জাগবে?

kamduni_body_041618021919.jpgকামদুনির ঘটনার পর মহিলাদের প্রতিবাদ (ফাইল ছবি)

আমার মনে হয় সমাজকে সচেতন করতে হলে প্রথমেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে হবে। জীবনশৈলী শিক্ষাকে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই শিক্ষার ব্যাপক দরকার রয়েছে আমাদের সমাজে। জীবনশৈলী শিক্ষা বা সেক্স-এডুকেশন মানে হল নিজের শরীর, মন ও আত্মার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়া।

বেশিরভাগ বাঙালি পরিবারে মহিলারা ধারাবাহিক দেখতে খুব পছন্দ করেন, তাই ওই সব ধারাবাহিকের অভিনেত্রীদের দায়িত্ব, তাঁরা যে চরিত্রগুলি করছেন, সেগুলোকে একটি আদর্শ মহিলা চরিত্র রূপে তুলতে ধরা।

অনেক সময় বলা হয়েছে যে একজনকে ধর্ষণ করা হল বা তাঁর শ্লীলতাহানি করা হল তাঁরই দোষে, কারণ তিনি হয়ত খোলামেলা পোশাক পরেছিলেন বলে পুরুষ তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। এই কথাগুলো যাঁরা বলেন, আমার মনে হয় তাঁদেরই সঠিক শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে এবং তাঁকেও পরিষ্কার করার প্রয়োজন রয়েছে। একজন মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে এ হেন মর্মান্তিক সময় নির্যাতিতার পোশাকআশাক নিয়ে কী ভাবে চিন্তা আসতে পারে একজনের মনে?

যাঁরা মেয়েদের পোশাকআশাক ডিজাইন করেন, তাঁদেরও চেষ্টা থাকে মেয়েদেরকে আরও বেশি মহিলা-সুলভ করে তোলা। তা না হলে একটা অনুষ্ঠানে পুরুষরা যান একদম সুটেড বুটেড হয়ে ও গলা বন্ধ পোশাক পরে, কিন্তু আবার সেই একই অনুষ্ঠানে একজন মহিলা যান খোলামেলা পোশাক পরে? আমি কিন্তু শরীর ঢাকা দেওয়া বা শরীর দেখানোর পক্ষে বা বিপক্ষে নই, কিন্তু একজন মহিলার পোশাকে রুচির পরিচয় থাকা উচিৎ।

ছোট বয়স থেকেই আমাদের সন্তানদের সঠিক জ্ঞান দিতে হবে। শিক্ষা মানে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া নয়, সত্যিকারের শিক্ষা হল মানবিক শিক্ষা লাভ করা। এই ধরণের শিক্ষার হাতে খড়ি বাড়ি থেকেই হওয়া উচিৎ। 

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Sunanda Mukherjee Sunanda Mukherjee

Former Chairperson, West Bengal Commission For Women

Comment