শশী থারুরের ‘হিন্দু পাকিস্তান’ মন্তব্যে তোলপাড় রাজনীতি, মন্তব্যের শিকড় কোথায়?
শাহ বানু মামলা থেকে অযোধ্যার মন্দিরের তালা খোলা, ইতিহাস অনেক গভীরে
- Total Shares
ভারতের রাজনীতি আজ কোন পথে এটা সাম্প্রদায়িক, নাকি ধর্মনিরপেক্ষতা গণতান্ত্রিক নাকি একনায়কতন্ত্র এই বিতর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে। ভারত আজ নির্দিষ্ট ভাবে দ্বিধাবিভক্ত। আর মাত্র কয়েকমাস বাদে লোকসভা নির্বাচন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যে ধারণা মানুষের সামনে খুব একটা স্পষ্ট ছিল না, ২০১৯ সালে সেটা অনেক বেশি স্পষ্ট এবং তীব্র।
আরএসএসের অঙ্কুলিহেলনে দীর্ঘ দিন ধরে বিজেপির নেতৃত্বে ভারতের রাজনীতিকে যে পথে চালিত করা হচ্ছিল, সেটাই আজ ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রস্থল। প্রশ্ন উঠেছে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে হিমা দাসের চোখের জলের রং নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে হিমা দাসের চোখের জল আরএসএস পন্থী নাকি কংগ্রেস পন্থী নাকি কমিউনিস্ট পন্থী নাকি সমাজবাদীপন্থী!
সন্দেহ আছে ভারতের মানুষ এই রঙীন রাজনীতিয়তে কতটা নিমজ্জিত অথবা তার নিজের নিজের স্বার্থে কতটা নিমগ্ন। যদি ধরে নেওয়া যায় যে আরএসএসের দর্শনকে সামনে রেখে বিজেপির রাজনীতি ভারতকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তা হলে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে যে এই রাজনীতির শুরুটা কোথা থেকে এবং কেন।
ভারত যে মিশ্র ধর্মভাবনার দেশ এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এ বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই যে ভারত ঐক্যবদ্ধ সংস্কৃতির দেশ। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট থেকে কংগ্রেস শাসনে ভারতে কোনও জাতীয় চরিত্র গড়ে তোলার কোনও প্রচেষ্টা কোনও দিন হয়নি। স্বাধীন ভারত প্রথম জাতীয় চরিত্র দেখেছে ১৯৮৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে। এতে রাজনীতির কোনও অবদান নেই, এতে প্রশাসনের কোনও অবদান নেই। এটা সম্পূর্ণ ভাবে ভারতবাসীর নিজের তৈরি করা আবেগ ও অনুভূতি।
স্বাধীনতার পরে ১৯৮৩ সালেই প্রথম কোনও সর্বভারতীয় চরিত্র তৈরি হল
সেই আবেগ ও অনুভূতি পরবর্তীকালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রিকেট খেলায় আরও সুসংহত হয়েছে। এর কারণ কী, তার ব্যাখ্যা সমাজবিজ্ঞানীরা দেবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন স্বচ্ছ ভারতের অভিযান করেন তখন এটা বিজেপির অ্যাজেন্ডা অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাজেন্ডা এমন একটি অপবাদ দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কৌশলী রাজনীতিকরা নির্মল বাংলা নাম দিয়ে পৃথক অভিযান শুরু করেন। সস্তা এই রাজনীতি কোনও দিনই কোনও জাতীয় চরিত্র তৈরি করতে পারে না। আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যখন পরাজিত জাপানি সমর্থকরা স্টেডিয়াম পরিষ্কার করতে ব্যস্ত থাকেন রাশিয়ায়, অথবা তাঁদের ড্রেসিংরুম পরিষ্কার করে ধন্যবাদ লিখে যান, তখন কিন্তু এই ভারতবাসীরাই সেটাকে ভাইরাল করেন। জাপানে স্বচ্ছ ভারত কখনোই নির্মল বাংলা হয় না। আর এই ভাবেই জাতীয় চরিত্র সেখানে গড়ে ওঠে। সেটা স্বচ্ছতাকেন্দ্রিক হতে পারে, সেটা ফুটবলকেন্দ্রিক হতে পারে, সেটা ক্রিকেটকেন্দ্রিক হতে পারে সেটা রানিকেন্দ্রিকও হতে পারে। লড়াইটা এইখানেই।
পরাজয়ের পরে রাশিয়ায় স্টেডিয়াম পরিষ্কার করেন জাপানি সমর্থকরা, এটাই তাঁদের জাতীয় চরিত্রের পরিচায়ক। স্বচ্ছতা নিয়ে তাঁরা রাজনীতি করেন না (এএফপি)
এই কারণেই দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের একটি তত্ত্ব আরএসএসের শিবির থেকে সামনে আনা হয়েছিল। শ্রীনগরের শঙ্করাচার্যের মন্দিরে যে উপচারে পুজো হয়, তামিলনাড়ুর রামশ্বরম মন্দিরেও সেই উপচারেই পুজো হয়। গুজরাটের সোমনাথের মন্দিরে যে উপচারে পুজো হয়, অরুণাচলপ্রদেসের পরশুরাম মন্দিরেও সেই একই উপচারে পুজো হয়। কিন্তু ভারতের মুসলিম জনসংখ্যার অজুহাতে এই তত্ত্বকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং তার পরিবর্ত হিসাবে অন্য কোনও তত্ত্ব কোনও দিন সামনে আসেনি সাম্প্রদায়িকতার অর্থহীন বিতর্কের কারণে।
এটা ঠিক যে ভারতে বৃহৎ সংখ্যক জনগোষ্ঠী ধর্মভাবনায় পৃথক। কিন্তু তারা ভারতবাসী হবে না কেন এই প্রশ্নটি তোলা হয়নি। ক্রীড়াক্ষেত্রে কোনও কোনও আন্তর্জাতিক আসরে ভারতের সাফল্যে এ দেশের কিছু নির্দিষ্ট অংশ যখন উৎসব প্রকাশ থেকে বিরত থাকে, সেই প্রেক্ষিতে প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক যে, যদি সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িক হয়, তা হলে তার বিকল্প কী?
বিকল্প হচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিকল্প হচ্ছেন এইচডি কুমারস্বামী, বিকল্প হচ্ছেন মায়াবতী, বিকল্প হচ্ছেন লালুপ্রসাদ যাদব, বিকল্প হচ্ছেন রাহুল গান্ধী। ভারতের একটি বড় সংখ্যক মানুষের মনে প্রশ্ন আছে এঁদের রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায় যে, দেশ, দর্শন, ইতিহাস, সামজবিজ্ঞান প্রভৃতি সম্বন্ধে এই সব মানুষের জ্ঞানের গভীরতা ঠিক কতটা এবং ঠিক কোন দর্শনের ভিত্তিতে তাঁরা ভারত গড়তে চান। আর এই প্রেক্ষাপটেই কংগ্রেসি নেতা এবং অতীব পণ্ডিত শশী থারুরের হিন্দু পাকিস্তান মন্তব্যের বিশ্লেষণ হওয়া জরুরি।
How we are turning out to be "just like them"! https://t.co/PWbhq4NqJ5#HinduPakistan
— Shashi Tharoor (@ShashiTharoor) July 15, 2018
এতদিন ভারতে আমরা আর্য-অনার্য শুনে এসেছি, দ্রাবিড় বা অদ্রাবিড় শুনে এসেছি, হিন্দু-মুসলমান বিতর্ক শুনে এসেছি, উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণ বিতর্ক শুনে এসেছি, শশী থারুর নতুন শব্দবন্ধনীর আমদানি করেছেন। এটা তিনি ভারতকে সম্মানিত করার করার জন্য নাকি অসম্মানিত করার জন্য করেছেন সেটা বোঝা মুশকিল। কিন্তু এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ম্যাকলে শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে মৌলিক ভাবে আরএসএস দর্শনের চুলচেরা বিশ্লেণ করা রয়েছে। সুপণ্ডিত শশী থারুররা সেই ম্যাকলে শিক্ষানীতিরই ফসল, তাঁরা সেই শিক্ষানীতিরই অনুসারী।
Since some have bizarrely misconstrued my statement on the BJP seeking to turn India into a #HinduPakistan, a short explanation of what the term means: https://t.co/8H5euZK5gy
— Shashi Tharoor (@ShashiTharoor) July 12, 2018
বয়সে নবীন শশী থারুরের মনে থাকার কথা শাহ বানু মামলা। যে দিন তাঁর দল কংগ্রেসই বিনা আয়াসে আরএসএসের দর্শনকে ভারতে মাটিতে গ্রথিত করেছেন। তাঁর মনে থাকার কথা অযোধ্যার রাম মন্দিরের তালা খোলার প্রেক্ষাপট যখন একই ভাবে আবার তাঁরই দল আরএসএসের দর্শনকে মাটির আরেকটু গভীরে গ্রথিত করেছে। আজ তাঁদের এই মায়াকান্না ভারতের কত শতাংশ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারবে সেটা ২০১৯ সালের নির্বাচন বলতে পারবে। কিন্তু তাঁদের নেতা রাহুল গান্ধী গুজরাট ও কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনে আরএসএসের দেখানো পথেই উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন অল্প কিছু ভোটের জন্য। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন রামনবমী থেকে জগন্নাথের রথযাত্রা, মাঝখানে শ্যামাপ্রসাদের জন্মদিন-মৃত্যুদিন।
শশী তারুর: তাঁর হিন্দু পাকিস্তান মন্তব্য নিয়ে এখন বিতর্ক দেশজুড়ে। তাঁকে তলব করেছে কলকাতার একটি আদালত
হিন্দু পাকিস্তান বলার মধ্য দিয়ে কংগ্রেস নেতা ভারতের হাজার হাজার বছরের দর্শন শিক্ষা ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও ইতিহাস – এই সব কিছুকেই যে এক কথায় অপমানিত করেছেন এটা বুঝতে পেরেই বোধহয় তাঁর দলীয় সতীর্থরা খুব একটা সোচ্চার হননি। ভারত হিমা দাসের চোখের জলে উড্ডীন থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের মসনদে যে চরিত্রই শীর্ষস্থানে থাকুক না কেন।