পুরআইন বদল করে কলকাতা পুরনিগমের মেয়র করা হচ্ছে ফিরহাদ হাকিমকে

ব্যক্তির জন্য আইন বদলের খেসারত দিতে হতে পারে পুরবাসীকে

 |  3-minute read |   23-11-2018
  • Total Shares

জওহরলাল নেহরু সরকারের সঙ্গে বেশ মিল পাওয়া গেল কলকাতা পুরনিগমের নতুন মেয়র মনোনয়নের ক্ষেত্রে। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে মনোনয়ন আসে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে ভারতরত্ন দেওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাতে সম্মতি জানান।

কাউন্সিলর না হলেও কলকাতা পুরনিগমের মেয়র হওয়া যাবে, এই মর্মে ওয়েস্ট মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অ্যাক্ট ১৯৮০-তে কয়েকটি সংশোধন করার প্রস্তাব বিধানসভায় পেশ করেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। সংখ্যাধিক্যের জেরে সেই বিল পাস হয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।

তারপরে তৃণমূল কংগ্রেস (রাজ্য সরকার ও কলকাতা পুরনিগমে এখন শাসকদল) নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের কাউন্সিলরদের কাছে জানতে চান কলকাতার মেয়র হিসাবে কাকে পছন্দ। মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ (যিনি সব দিক থেকে এই পদের দাবিদার) ফিরহাদ হাকিমের নাম প্রস্তাব করেন (যিনি মুখ্যমন্ত্রীর পাশেই বসেছিলেন)। তারপরে ডেপুটি মেয়র হিসাবে সকলে বেছে নেন অতীন ঘোষকে।

newmayor_body_112318035102.jpgতাঁকে পরবর্তী মেয়র বলে ঘোষণা করার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রণাম করছেন ফিরহাদ হাকিম, পাশে অতীন ঘোষ (পিটিআই)

চিত্রনাট্য তৈরিই ছিল, তা বোঝা যায় কোনও পদের জন্যই দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম কেউ উচ্চারণই করলেন না!

এক কথায়, কলকাতার কাউন্সিলর নন এমন এক ব্যক্তি ফিরহাদ হাকিম মেয়র হবেন বলে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বিধানসভায় আইন সংশোধনের প্রস্তাব পেশ করেন। জওহরলালের সঙ্গে পার্থক্য একটিই, জওহরলাল নিজেই কংগ্রেসের ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন, এখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে ফিরহাদ হাকিম নেই, রয়েছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৪৪টি আসনের কলকাতা পুরসভায় এই মুহূর্তে তৃণমূলের ১২২ জন কাউন্সিলর আছেন। তাঁদের মনোনীত করেছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভোট দিয়ে নির্বাচিত জনগণ। তাঁদের মধ্য থেকেই মেয়র পারিষদ ও বরো চেয়ারম্যানরা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কি যোগ্য নন মেয়র পদের জন্য? বিধানসভাতেই প্রশ্নটি তুলেছিলেন বিজেপি বিধায়ক (রাজ্য সভাপতিও) দিলীপ ঘোষ। তাতে রাজনৈতিক উত্তর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে প্রশ্ন হল, পছন্দের ব্যক্তির জন্য আইন বদল – গণতন্ত্র রক্ষিত হল তো?

রাজ্যে গণতন্ত্র নেই বলে প্রচার করছে বিজেপি, তাদের আসন্ন রথযাত্রার কারণও গণতন্ত্র উদ্ধার করা বলে প্রচার করছে বিজেপি। ঠিক তখন আইন বদল করে বিজেপির হাতে কি অস্ত্র তুলে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?

 

mamata-sovon-boby_112318035409.jpgপদত্যাগ করার আগে একটি অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায় (পিটিআই)

আইনে আরও বদল হয়েছে। ছ’মাসের মধ্যে ভোটে জিতে এসে কাউন্সিলর হতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতাও রাখা হয়নি। বলা হয়েছে ছ’মাসের মধ্যে কোনও কারণে নির্বাচন সম্ভব না হলে রাজ্য সরকার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মেয়রের কাজের মেয়াদ বাড়িয়ে দিতে পারে, কতদিনের জন্য সেই মেয়াদ বাড়াতে পারে সে কথা আইনে উল্লেখ করা হয়নি। পুরসভায় নির্বাচন পরিচালনা করে রাজ্য নির্বাচন কমিশন, আইন যাঁকে কোও ক্ষমতাই দেয়নি। সব মিলিয়ে ফিরহাদ হাকিমকে যতদিন খুশি তাঁর পদে বহাল রাখতে পারবে রাজ্য সরকার।

আপৎকালীন অবস্থায় বা জরুরি পরিস্থিতিতে মেয়রকে যে ক্ষমতা দেওয়া ছিল তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে, একই সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হয়েছে মেয়রের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি মেয়রকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, সেই ক্ষমতাও। অর্থাৎ ক্ষমতা রাশ অনেকটাই চলে গেল রাজ্য সরকারের হাতে।

দিল্লির একজন মুখ্যমন্ত্রী থাকলেও সব ক্ষমতা যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ঠিক ততটা না হলেও কলকাতা পুরনিগমের ক্ষমতা অনেকটাই নিয়ে নিল রাজ্য সরকার।

এখন রাজ্য সরকার ও কলকাতা পুরসভা – দু’জায়গাতেই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল কংগ্রেস ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল হওয়ায় যতদিন একই দল এই দু’জায়গায় ক্ষমতায় থাকবে ততদিন কোনও সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু রাজ্যের পরিচালনা ও কলকাতা পুরনিগম পরিচালনার ভার দু’টি পৃথক রাজনৈতিক দলের হাতে থাকলে তখন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কলকাতার পুরবাসীদের ভুগতে হবে না তো?

এই আইন পুরো রাজ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। তাই শুধু কলকাতা নয়, রাজ্যের যেখানে পুরনিগমে এই মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় নেই, সেই সব জায়গায় পদে পদে সমস্যায় পড়তে হতে পারে ক্ষমতাসীন দল বা জোটকে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, শিলিগুড়িতেই এখন পুরবোর্ডে ক্ষমতায় আছে বামফ্রন্ট।

mamata_shovon_112318035502.jpgসুখের সে দিন, মেয়রের মাথায় আশীর্বাদের হাত মুখ্যমন্ত্রীর (ফাইল চিত্র)

সাংবিধানিক বাধা না থাকলেও শোভন চট্টোপাধ্যায়কে নজিরবিহীন ভাবে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া সত্ত্বেও কলকাতার মেয়রের পদেও তাঁকেই বহাল রেখেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি পদত্যাগ করায় পুর আইন বদল করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নজির ভেঙে সেই পদে বসাচ্ছেন ফিরহাদ হাকিমকে, বিধায়ক ও মন্ত্রী হলেও তিনি কাউন্সিলর নন, মেয়র হতে গেলে যা আবশ্যিক। এ জন্য আইনও বদল করা হল।

আইন প্রণয়ন হয় কোনও পরিস্থিতি তৈরি হলে। পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য আইন প্রণয়ন করা সম্ভবত বিরল।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMITRO BANDYOPADHYAY
Comment