ভবিষ্যতের ভূত: বহু যুগ ধরে পশ্চিমবঙ্গে দু'মুখো উদারপন্থীদের ভূত তাড়া করে বেড়াচ্ছে

তাঁর উত্তরসূরি এই বামফ্রন্ট সরকারের কাছ থেকেই মমতা বন্দোপাধ্যায় এই ধারাটি রপ্ত করেছেন

 |  3-minute read |   20-02-2019
  • Total Shares

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পছন্দ করার একাধিক কারণ রয়েছে।

একেবারে নিখাদ বাংলা উচ্চারণে তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করতে সিদ্ধহস্ত। আর, আমাদের মতো যারা সর্বদাই হেডলাইনের খোঁজ করে বেড়াই তাদেরকেও তিনি সদা উল্লসিত করে রাখতে পারেন।

তিনি শারুখ খানকে তাঁর সান্ত্রো গাড়ির পিছনের আসনে বসার নির্দেশ দিতে পারেন। আবার, হাওয়াই চটি পড়ে স্বচ্ছন্দে আম্বানির মেয়ের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেন। তাঁর দলের নেতা নেত্রীরা সারদা থেকে নারদা সমস্ত রকম কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়তে পারে যার ফলে 'মা' ও 'মানুষ' পায়ের তলায় মাটি হারাতে পারে। তবে তিনি কিন্তু স্পার্টানদের মতো জীবনযাপন করেন, পশ্চিমবঙ্গে সবচাইতে ক্ষমতাবান নাগরিক হওয়ার পরেও।

কিন্তু দিদির একটি মাত্র আচরণই কিন্তু তাঁর প্লাস পয়েন্টগুলোকে মাইনাস করে দিচ্ছে।

উদারপন্থী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু দু'মুখো। তাঁর রাজ্যের অনেকেই মুখে কার্ল মার্ক্সের কথা বললেও মার্ক্স্ বা স্পেন্সারের মতো বহুজাতিক সংস্থায় বাজার করতে যান। তাঁদের মতোই তিনিও হাওয়াই চপ্পল পড়ে 'বড়' 'বড়' ভাষণ দিয়ে থাকে।

body_022019050514.jpgফাঁপরে না পড়লে তিনি কিন্তু উদারপন্থী [ছবি: রয়টার্স]

পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বসবাসকারী আমাদের মতো 'লিমুজিন লিবারালরা' (যদিও আমার কোনও লিমুজিন গাড়ি নেই) তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম যখন তিনি পদ্মবৎ সিনেমা দেখানো নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার সময়ে লাল কার্পেট পেতে সিনেমাটিকে পশ্চিমবঙ্গে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন (একদম ঠিক কাজই করেছিলেন)। কিন্তু এবার তাঁর সরকারকে সমালোচনা করার জন্য তিনি একটি বাংলা সিনেমা দেখানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন (যা একেবারেই ভুল কাজ)।

২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া ভূতের ভবিষ্যৎ সিনেমাটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই সিনেমায় এক দল ভূত মিলে একটি হানাবাড়িতে শপিং মল গড়ে তোলার প্রচেষ্টা বন্ধ করেছিল। সেই সিনেমারই পরবর্তী ভাগ ভবিষ্যতের ভূত। এই হানাবাড়ির সঙ্গে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের কোনও মিল আছে কী না তা তো ব্যাখ্যা করে দেখতে হবে, কিন্তু এই সিনেমা যে ইতিমধ্যেই দিদির আঁতে ঘা মেরেছে তা বলাইবাহুল্য।

এছাড়াও, কেন কলকাতা চলচিত্র উৎসব চত্ত্বর জুড়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বড় বড় কাটআউট টাঙানো হবে তা নিয়ে এর আগে সরব হয়েছিলেন এই সিনেমাটির পরিচালক অনিক দত্ত। এই সিনেমা বন্ধ করে দেওয়ার পিছনে এই কারণটাও কাজ করতে পারে।

body1_022019050703.jpgপরিচালক অনিক দত্ত এর আগে মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করেছিলেন, তাই কি কোপ পড়ল? [সৌজন্যে: টুইটার]

যে কারণেই হোক না, ভবিষ্যতের ভূত সিনেমাটির উপর নিষেধাজ্ঞা এমন একটি শহরে জারি করা হল যে শহরটি সাধারণত উদারতা এবং বাকস্বাধীনতাকে মান্যতা দিয়ে থাকে।

পছন্দ করুন কী না করুন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই কিন্তু গোটা ভারতবর্ষে বাংলার মুখ। তাই, ভবিষ্যতের ভূত বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আমরা একজন দু'মুখো উদারপন্থীর মুখ দেখতে পাচ্ছি। এ এক দশক প্রাচীন স্বভাব - একদিকে ভালো বই পড়ার অভ্যাস, ভালো সিনেমা দেখার অভ্যাস ও ভালো কাজের পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস নিয়ে গর্ববোধ করা, আবার অন্যদিকে, বাকি ভারতবর্ষের মতোই আচরণ করা।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উত্তরসূরি বামফ্রন্ট সরকারের থেকে এই অভ্যাস রপ্ত করেছে।

তসলিমা নাসরীনকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।

২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতা থেকে 'তাড়িয়ে' দেওয়া হয়েছিল যখন কিছু মুসলমান গোষ্ঠী তাঁর রক্ত দাবি করেছিল। একজন লেখিকার, যাঁকে তাঁর দেশ থেকেও বিতাড়িত করে দেওয়া হয়েছে, পাশে না দাঁড়িয়ে কিংবা বাকস্বাধীনতাকে পাত্তা না দিয়ে সিপিএম তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, যেখানে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন।

আগে মুসলিম ভোট।

body2_022019050809.jpgনিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করছে কলকাতা, দিদি কি শুনতে পাচ্ছেন? [সৌজন্যে: ফেসবুক]

তারপর না হয় বাকস্বাধীনতার কথা ভাবা যাবে।

বামপন্থীদের দু'মুখো উদারতার কথা লিখতে বসলে তালিকাটি খুব বড় হয়ে যাবে। তবে ১৯৭৯ সালে যেভাবে সুন্দরবনের একটি ছোট দ্বীপে কয়েক হাজার শরণার্থীকে মেরে ফেলা হয়েছিল তা এই তালিকার সবার উপরে আসবে। বিরোধী আসনে থাকার সময়ে বামপন্থীরা এই শরণার্থীদের পাকা ঘর করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতা দখলের পরেই সেই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়েছিল।

সরকারি অনুমতি ছাড়াই এই শরণার্থীরা মরিচঝাঁপির অনুধ্যষিত দ্বীপে বাসা বেঁধেছিল।

আর, এতেই বামপন্থীদের আঁতে ঘা লেগে যায়। এরপর পুলিশ দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়, এমনকি মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়। এই খবর যাতে বিশ্ব জানতে না পারে তার জন্য সংবাদমাধ্যমেরও কণ্ঠরোধ করা হয়।

মুখে এক কাজে আরেক - পশ্চিমবঙ্গের এই ধারার বহু রাজনৈতিক উদাহরণ রয়েছে। যাঁরা রাজ্য ছেড়ে বেরিয়ে এসে এখন দিল্লির সংবাদপত্রে ডানপন্থীদের সমালোচনা করে থাকেন তাঁরাও এই ধারায় প্ৰভাবিত।

আর, এসবের মাঝেই পশ্চিমবঙ্গের হানা বাড়ির ভাগ্য এখন ভবিষ্যতের ভূতেদের হাতেই সমর্পিত রয়েছে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

DAIPAYAN HALDER DAIPAYAN HALDER @daipayanhalder

Executive Editor, India Today Group Digital

Comment