রুপোলি পর্দার তারকারা আগেও ভোটে লড়েছেন, তবু তৃণমূলের অভিনেত্রী-প্রার্থীদের নিয়ে কুৎসা

সব দলেই প্রার্থী হন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা, দক্ষিণে তো একাধিক মুখ্যমন্ত্রীও রয়েছেন

 |  6-minute read |   28-03-2019
  • Total Shares

তা হলে আপনার কেন্দ্রে মিমি নাকি নুসরত, কে দাঁড়াচ্ছে?

কেন, আগে যখন অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় বা তাপস পালরা দাঁড়িয়েছিলেন তখন এই প্রশ্ন কেউ করেননি, এমনকি শতাব্দী-দেবশ্রী দাঁড়ানোর সময়ও এই প্রশ্ন কেউ তোলেননি, এখন মিমি-নুসরতের বেলায় এই প্রশ্ন উঠছে কেন, ওঁরা মেয়ে আর কম বয়সী বলে? ন্যূনতম সৌজন্য দেখিয়ে আপনি বলে সম্বোধনও করতে ভুলে গেছেন দেখছি!

ভীমের চায়ের দোকানে সকাল সকাল লড়াই। চায়ের ভাঁড়ে তুফান এখানে নতুন কিছু নয়। তবে মিমি-নুসরতদের নিয়ে যে ভাবে ক’দিন বিভিন্ন জায়গায় মিমি নুসরতদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা শুনতে শুনে শ্যামল ক্লান্ত। তাই আজ ষাটোর্ধ্ব অমলদার কথা শুনে পাল্টা কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিলেন শ্যামল। একটানা কথাগুলো শুনিয়ে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিল।

mimi-chakraborty_032819061329.jpgভোটের প্রচারে মিমি চক্রবর্তী। (ছবি: সংবাদসংস্থা)

অনেকটা চিত্রার্পিতের মতো ছোটো কাচের গেলাসটা ধরে থেকে এতক্ষণে চুমুক দিলেন অমলদাও। এমন প্রতিবাদে তিনিও খানিকটা হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন। চায়ের গেলাস মুখ থেকে নামিয়ে তিনি বললেন, “আমি না হয় একটু মজাই করে ফেলেছিলাম, কিন্তু কানুবাবুদের দল তো প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে যাতা বলছেন। কেউ তো ছবি দেখিয়ে বলছেন উনি ছেলে না মেয়ে। কংগ্রেস আবার ওঁকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করছে।”

কথা শেষ হতে না হতেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন কানাইলাল ঘোষ, উনি একটু বিজেপি ঘেঁষা বলে লোকে মনে করেন। চুমুকটুকু শেষ না করেই বললেন, “শুনুন, আমি কোনও পার্টি করি না, তাই আমার কোনও দল-দল নেই। যারা এ সব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাদের মানসিক চিকিৎসা হওয়া দরকার। তারপরেও বলছি, লালপ্রসাদ যখন বলেছিলেন বিহারে হেমা মালিনীর গালের মতো রাস্তা করে দেব, তখন কেন কেউ কোনও প্রতিবাদ করেননি? তখন তো লোকে বেশ মজাই পেয়েছিল। আর ভাই  শ্যামল, তুমি আর শতাব্দী রায়ের কথা বলো না, উনি বক্তৃতায় যে সব কথা বলতেন, তা এক কথায় অশ্রাব্য, তাপস পাল কী বলেছেন তা যত না বলা যায় ততই ভালো। তাঁদের নিয়ে কেউ কথা বলবে কী, তাঁরা নিজেরাই তো এক একটি সম্পদ!”

অমলদার মুখটা শুকনোই। ক্রিম-ক্র্যাকারে কামড় দিয়ে গলাটাও কেমন শুকিয়ে গেছে। মিইয়ে যাওয়া বিস্কুটের মতোই মিন-মিন করেই বললেন, “বামফ্রন্টের হয়ে অনেকেই ভোটে লড়েছেন, তাঁরা সকলেই বামপন্থী মানসিকতার ছিলেন। যে কেউ বামফ্রন্টের, সোজা কথা সিপিএমের হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না। আর সিপিএম হল ক্যাডার-নির্ভর দল, এই দলের সঙ্গে অন্যদের তুলনা করাটা ঠিক নয়।”

আজকাল সকলেই তৃণমূল, কিন্তু ঘরোয়া আড্ডা বলতে যা বোঝায়, সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকদের কটাক্ষ শুনতে হচ্ছে, মিমি চক্রবর্তী ও নুসরত জাহানকে নিয়ে হাসিঠাট্টা প্রায় কোনও সময়ই শালীনতার মাত্রা মানছে না। তাই এতদিনে মুখের মতো জবাব দিতে পেরে শ্যামল বেশ তৃপ্ত। ঝাঁঝটাও কমেছে গলার। সে একটু শান্ত গলাতেই বলল, “সিপিএমের ক্যাডার আজকাল পাওয়া মুশকিল হচ্ছে। কংগ্রেসের সঙ্গে জোটটাও হল না। গত বার তো দুটো আসন পেয়েছিলেন, এ বার কটা পাবেন? কেরলের সিপিএম তো আজকাল লিখছে, আমাদের কোনও শাখা নেই।” শান্ত আর শ্লেষ মেশানো কথা অন্তত শ্যামলের থেকে শোনা যায় না। প্রথম ভাঁড়টা শেষ করে সে আরেকটা চায়ের অর্ডার দিয়েছে। মানে আলোচনাটা আরেকটু চলুক, এটাই সে চাইছে।

priyankagandhi-ani_032819061443.jpgতাঁকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করছে কংগ্রেস। (ছবি: সংবাদসংস্থা)

এমনিতে খেলার বাইরে অন্য কোনও ব্যাপারে তেমন মন্তব্য করে না সমীর। এ দিন না করে পারল না, “আমাদের এখানে যত হইচই। অন্য জায়গায় দেখুন, কে ভোটে দাঁড়ায়নি, অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না, রাজ বব্বর, হেমা মালিনী, জয়া প্রদা, এমনকি পরেশ রাওয়াল পর্যন্ত। ওদের নিয়ে এত হইচই হয় বলে তো শুনিনি। সকলেই ভোটে দাঁড়াতে পারে, ফিল্ম স্টাররা দাঁড়ালেই যত কথা।”

এবার একটু হালে পানি পেয়েছেন অমলদা। তিনি বেশ স্বতস্ফূর্ত ভাবেই বললেন, “ভোটে তো কীর্তি আজাদ, আজহারউদ্দিনও দাঁড়িয়েছে, এ বার তো গৌতম গম্ভীর বিজেপিতে। তো, তাদের ছেড়ে তুমি আবার সিনেমা-আর্টিস্টদের নিয়ে কেন পড়লে?”

“না, এ সব নিয়ে কথা হচ্ছিল, তাই।” – বাঙালিদের এই এক স্বভাব, কথা শুরুই করে না শব্দটি দিয়ে। বিষয়টা ইতিবাচল হলেও না, নেতিবাচক হলে তো কথাই নেই! সমীরও ব্যতিক্রমী নয়। এইটুকু বলেই সে খবরের কাগজের পিছনের পাতায় মনোনিবেশ করল। পলিটিক্যাল তর্কে সে খুব একটা স্বচ্ছন্দ নয়, নেহাত বলতে হবে, তাই বলেছে।

লালটু যথারীতি মোবাইল ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে চা খাচ্ছিল। সে মোবাইল ফোনে চোখ রেখেই বলল, “সমীর, ভালোই বলেছিস ভাই। শুধু রাজেশ খান্নার নামটা বাদ দিয়ে দিলি। বেচারি, তাঁকে আর ফ্যানেরাও মনে রাখছে না। আর এবার কমল হাসানও রাজনীতিতে।”

অমলদার চা শেষ, গেলাস নামিয়ে বললেন, “এখানে তো তবু ভোটে লড়ে, সাউথে আবার আস্ত একটা দল গড়ে ফেলে। এই সব দল যে কদিন থাকবে, আর কারা ভোট দেবে, কেন দেবে কে জানে! সিনেমা নিয়ে থাকলেই তো পারত।”

লালটু এ দিন তেমন বিধ্বংসী মেজাজে ছিল না, তবু বলল, “কেন অমলদা, দক্ষিমের তারকারা তো রাজনীতিতে বেশ সফল। কবি-সাহিত্যিকরাও। আপনি এনটি রামা রাও, রামচন্দ্রণ, জয়ললিতা এমনকি কবি বলে পরিচিত করুণানিধির কথাই ধরুন না, এঁরা তো সকলেই মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন, এঁদের পরেও দলটা উঠে যায়নি, উল্টে এখনও লোকে তাঁদের স্মরণ করেন। চিরঞ্জীবীর কথা ধরুন, ২০০৮ সালে প্রজা রাজ্যম দল গড়লেন, বিধায়ক হলেন। বছর আড়াই পরে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর মিশে গেল, তিনি রাজ্যসভার সাংসদ হলেন, তারপরে পর্যটনমন্ত্রী হয়ে গেলেন। তারপরে আর রাজনীতিতে নেই। কিন্তু কথা হল, তিনি তো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন! আমাদের এখানে তেমন দৃষ্টান্ত কোথায়! নেই বললে অবশ্য ঠিক বলা হবে না, ব্রাত্য বসু আর ইন্দ্রনীল সেন এখন রাজ্যের মন্ত্রী।”

এবার শ্যামল পুরোনো কথার জের টেনে বলে, “অমলদা, আপনি কথায় কথায় বলেন, আপনাদের সময়ে উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরীরা বাম মনোভাবাপন্ন ছিলেন। আমাদের সময়ে দেব-ইন্দ্রনীল সেনরা তৃণমূল মনোভাবাপন্ন হলেই সমালোচনা!” লালটু হেসে বলে, “যাই বলিস ভাই, তোদের মতো মরণোত্তর তৃণমূল কোথাও দেখা যায় না। হতে পারে সুচিত্রা সেন বেঁচে থাকলে তৃণমূলের টিকিটে ভোটে দাঁড়াতেন, কিন্তু মঞ্চে তাঁর ছবি তুলে ধরে প্রচার! ফরওয়ার্ড ব্লকও বোধহয় কোনও দিন বক্তৃতার মাঝে নেতাজির বাঁধানো ছবি তুলে ধরে ভোট চায়নি।”

অপ্রস্তুত হলেও জবাব দিল শ্যামল, “বিজেপি-ও তো সর্দার প্যাটেলের ছবি টাঙায়, ভাবখানা এমন যেন প্যাটেল বেঁচে থাকলে বিজেপি করতেন।” কথাটা কানুদার ভালো লাগবে না স্বাভাবিক, তা ছাড়া তিনি ওঠার তোড়জোড় করছিলেন। উঠতে উঠতেই বললেন, “সর্দার প্যাটেলের আদর্শ ছিল, সেই আদর্শ মেনে কেউ চললে তাঁর ছবি দেওয়ালে টাঙাতেই পারে, সে তো লোকে রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের ছবিও টাঙায় দেওয়ালে, কিন্তু সুচিত্রা সেনের মতো অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছবি তুলে ধরা, এমনটা এই প্রথম। আর কানুবাবু যে বললেন ওঁরা ক্যাডারভিত্তিক দল, তার মানে কী সেটাই বুঝি না। এখানেও তো এখন পরিবারতন্ত্র। ফুয়াদ হালিম তার উদাহরণ।”

img-20190121-wa0043_032819062105.jpg

কানুদাও উঠে পড়েছেন ততক্ষণে, তবু জবাবটা দিলেন, “ফুয়াদ নিজে তো ডাক্তার, তা ছাড়া ভোটে লড়ছে দলের স্বার্থে, নিজের আখের গোছাতে নয়। তা হলে তো এই বাজারে ডাক্তারি সরিয়ে রেখে সিপিএমের হয়ে লড়ত না!”

লালটু হেসে বলে, “তা ভালো, তবে কী জানেন, আপনাদের দলের এক নেতার বিরুদ্ধে পোস্টার পড়েছে যে তিনি অখাদ্য-কুখাদ্য খান, তাই যেন ঘরে না ঢোকেন!” তীরটা যে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের দিকে, সে কথা বিলক্ষণ বুঝেছেন কানুদা। ভোট বড় বালাই, সেখানে এখন ধর্মের হাওয়া লেগেছে। তাই বামেদের গড়ে এখন টিমটিম করে জ্বলতে থাকা দু’টি পিদিম ভোটের পরেও জ্বলবে কিনা, তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ রয়েছে কানুদার মনে। তাই মুচকি হেসে, হালকা আড়মোড়া ভেঙে তিনি রওনা হলেন বাড়ির দিকে।

সাইকেলের চাবিটা পকেট থেকে বার করে লালটু বলল, “শ্যামল, আজকাল দেখছি তোর ঝাঁঝটা একটু কমেছে, কি ব্যাপার?” এমন প্রশ্নের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না শ্যামল। উত্তর সে দিতই। কিন্তু ততক্ষণে সাইকেলে চেপে বাড়ির দিকে রওনা হতে প্যাডেলে চাপ দিয়েছে লালটু। সে এমন একটা কথা বলল, দ্বিতীয় চা-টা যেন বিস্বাদ হয়ে গেল। ফুরফুরে মেজাজটা কেমন যেন হয়ে গেল।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Comment