আত্রেয়ী বাঁচাতে উদ্যোগী দু-দেশের নাগরিকই, প্রধানমন্ত্রীও শুনবেন তাঁদের ‘মন কী বাত’
তিস্তার পাশাপাশি আলোচনা হোক আত্রেয়ী নিয়েও, চাইছেন দু-পারের মানুষই
- Total Shares
আত্রেয়ী নদী এখন মৃতপ্রায়। যাঁরা এই নদীর উপরে গত ৪০-৫০ বছর ধরে নির্ভরশীল বা মৎস্যজীবিকার সঙ্গে যুক্ত, আজ তাঁরা কাজ পাচ্ছেন না। তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পেশা পরিবর্তন করে অনেকেই দিল্লির মতো শহরে চলে যাচ্ছেন শ্রমিকের কাজ করতে। অনেকে আবার শহরে থেকে রিকশাও চালাচ্ছেন। যে মৎস্যজীবীরা এখনও এই নদীর উপরে নির্ভরশীল, আত্রেয়ীকে বাঁচাতে আমরা তাঁদেরও এই আন্দোলনে যুক্ত করেছি।
নদী বাঁচাতে আলোচনা নদীর পাড়েই
শুধু মাছ শিকার নয়, যাঁরা নৌকা বানাতেন, আজ তাঁরাও সঙ্কটে। তাঁদের জীবন ও জীবিকা সঙ্কটে। সেই শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যাঁরা কৃষিজীবী, এই নদীর জলে সেচের কাজ করতেন, তাঁরাও সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। নদী থেকে জল তোলার যন্ত্রও অকেজো হয়ে পড়ছে। এত সমস্যার মূল কারণ হল নদীতে জল নেই। বৃষ্টি না হওয়া সত্ত্বেও কখনও কখনও এই নদীতে হড়পা বান দেখা যাচ্ছে।
২০০৬ সাল থেকে মূলত ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এই আন্দোলন শুরু করেছিলাম। তখন আত্রেয়ী বাঁচাও আন্দোলন নাম ছিল না। সেটি ছিল নদী দূষণ। এ ছাড়াও যে সব স্থানীয় সমস্যা রয়েছে যেমন পাড় ভাঙা, নাব্যতা হ্রাস, চর জেগে ওঠা, শহরের যে নিকাশীর অভিভুখ সেটি নদীকেন্দ্রিক হওয়ায় তজ্জনিত দূষণ, নদীর বুকে বা নদীখাতে কৃষকরা বর্ষা ছাড়া অন্য সময়ে যে চাষাবাদ করার সময় যে সব কীটনাশক ব্যবহার করেন তার ফলে জল দূষণ, নদীতে ঠাকুর বিসর্জন – এই ধরনের সমস্যা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করি।
এই সময়ই আমরা লক্ষ্য করলাম যে উপযুক্ত জল ও পরিবেশ না পেয়ে প্রচুর সংখ্যায় মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। বাঘা আড়, মহাশোল, গাগর, বালিচাটা প্রভৃতি যে সব মাছ স্থানীয় ভাবে পাওয়া যেত সেগুলো আর পাওয়া যাচ্ছে না। জলের রুপোলি শস্য বলে এখান মানুষ যে মাছকে চেনে, যেটি বরোলির মতো বিখ্যাত, সেই রাইখড় মাছেরও আকার ছোট হয়েছে, স্বাদ কমেছে। প্রচুর মাছ চিরতরে হারিয়ে গেছে বা হারিয়ে যেতে বসেছে। এটা নিয়েও এ বার কাজ শুরু করলাম।
আত্রেয়ীর সঙ্গে এক সময় তিস্তার যোগ ছিল। করতোয়া থেকে এই নদীর উৎপত্তি। আগে তিস্তার জলে পুষ্ট ছিল। কিন্তু ১৭৮৭ সালে প্রবল ভূমিকম্পে নদী গতিপথ পরিবর্তন করে। তার পর থেকে তিস্তার জল আর পায় না।
কেন বাঁচাতে হবে এই নদী, উত্তর ব্যানারেই
এই নদীর দৈর্ঘ্য ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে মোট ৩৯০ কিলোমিটার। ভারতের মধ্যে ৫৮ কিলোমিটার রয়েছে, সেটি দক্ষিণ দিনাজপুরে—কুমারগঞ্জ ব্লকে ৩৬ কিলোমিটার ও বালুরঘাট ব্লকে ২২ কিলোমিটার। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে আমরা একটি বিষয় লক্ষ করলাম। স্থানীয় এক কৃষক আমাকে জানালেন যে তাঁদের ফলস ভেসে যাচ্ছে, কারণ বাংলাদেশ জল ছেড়ে দিয়েছে। তখন তার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলাম। নদীর স্যাটেলাইট মানচিত্র পর্যালেচনা করতে শুরু করলাম। তখন দেখলাম যে সমঝিয়া থেকে ১৪০০ মিটার দূরে বাংলাদেশে একটি বাঁধ রয়েছে যাকে ওঁরা বলছেন রাবার ড্যাম। এই রাবার ড্যামের মাধ্যমেই জল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যখন জলের পরিমাণ কম থাকছে তখন ওঁরা জল আটকে রাখছেন। যখন বেশি থাকছে, তখন তা উপছে পড়ছে। জল উপছে পড়লেই দেখা যাচ্ছে, এখানে বৃষ্টি না হলেও জল চলে আসছে। হয়তো দুপুরে জল নেই, কিন্তু বিকালে জল চলে এল। নদীর বুকে যাঁরা চাষাবাদ করেন, এর ফলে তাঁদের ক্ষতি হচ্ছে।
নাব্যতা হারিয়েছে অনেক আগেই
এই বাঁধের কথা আমরা স্থানীয় জেলাশাসককে জানাই। তাঁকেই প্রশ্ন করি যে বাংলাদেশ এ ভাবে জল ছাড়তে পারে কিনা। মূলত কৃষকদের সমস্যা নিয়েই জেলাশাসককে চিঠি দিই। বিশয়টি ধীরে ধীরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সেচমন্ত্রী, সাংসদ এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও পৌঁছে যায়। অর্থাৎ তখন থেকে স্থানীয় সমস্যার সঙ্গে আরও একটি সমস্যা যুক্ত হল। পরে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি চিঠি লিখে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রীর মন-কি-বাত অনুষ্ঠানের জন্য আমার সাক্ষাৎকারও রেকর্ড করা হয়েছে।
কিছুদিন আগে আমি দিল্লিতে গিয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ড্যামস রিভার অ্যান্ড পিপলের কোঅর্ডিনেটর হিমংশু ঠক্করের সঙ্গে আলোচনা করেছি এ নিয়ে। ওঁরাও ওঁদের বৈঠকে নিশ্চিত ভাবেই আত্রেয়ীর কথা উত্থাপন করবেন। বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকেও জানিয়েছিলাম আমাদের সমস্যার কথা। জানতে চেয়েছিলাম এই জলাধারের বিষয়ে। এখন মোটামুটি রাষ্ট্রপতি-সহ দেশের সর্বস্তরে এই সমস্যা নিয়ে নিয়মিত ভাবে চিঠি পাঠিয়ে যাই।
জল নেই, শুধুই বালি জেগে আত্রেয়ীর বুকে
শান্তিনিকেতনে যখন ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আসেন, তখনও আমি চিঠি পাঠাই যাতে এই বিষয়টি দু-দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে উঠে আসে। তিস্তা নিয়ে যদি আলোচনা হয়, তা হলে আত্রেয়ী নয় কেন? দু-দেশের সরকারের পাশাপাশি দু-দেশের মানুষও এ নিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। আমরা চাই সরকারের পাশাপাশি দু-দেশের মানুষ নদী নিয়ে এই আন্দোলন করুক, তাতে দু-দেশের সরকারের উপরেও চাপ তৈরি হবে, সেটা একটা দৃষ্টান্তও হবে। বাংলাদেশে যাঁরা নদী ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি এবং বাংলাদেশের যে নদী বাঁচাও সংগঠন, তারাও সম্মতি দেয় একসঙ্গে কাজ করার। একটি প্রতিনিধি দলও বালুরঘাটে এসেছিল দিন দুয়েক আগে। আমরা তাঁদের আত্রেয়ীর কয়েকটি অংশ ঘুরিয়ে দেখাই। সেখানেই স্থর হয় যে আগামী সেপ্টেম্বরে আত্রাই সাংস্কৃতিক উৎসবে আলোচনা সভায় আমরা যোগ দেব (বাংলাদেশে আত্রেয়ী নদীকে আত্রাই বলা হয়)। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি আমরা দু-দেশের মানুষও এই নদীকে বাঁচাতে একই ভাবে উদ্যোগী হয়েছি।