গণতন্ত্রের বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ: জনগণের বড় অংশ এই ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন

দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও বেকারত্বের জন্যই গণতান্ত্রের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন

 |  3-minute read |   18-09-2018
  • Total Shares

দিন আসে দিন যায়। গত শনিবার দিনটাও এই ভাবে চলে গেল। ওই দিনটি ছিল আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সনদ অনুযায়ী এগারো বছর ধরে দিনটি পালিত হচ্ছে। এই আবহে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত ভারতের, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে ফিরে তাকানো যাক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির উপনিবেশ গুটিয়ে গিয়ে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়। ১৯৪১ সালে মাত্র ১১টি দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ছিল। বর্তমানে, বিশ্বের ১৯২টি দেশের মধ্যে ১২৫টির মতো দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু রয়েছে।

সম্প্রতি, দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স বিশ্ব জুড়ে এক সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষার মূল বিষয় হল বিশ্বে চালু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোন অবস্থায় রয়েছে। এই সমীক্ষায় ধরা পড়েছে গণতন্ত্রের সামনে এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ হল, বিশাল সংখ্যক মানুষ এই ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ এবং বেকারত্বের কারণেই মানুষের এই অনাস্থা। 

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এই পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে গতিশীল ও শক্তিশালী সুশীলসমাজের আন্দোলনে। সমীক্ষা বলছে, ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ভারতে সুশীলসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তার পর থেকে সুশীল সমাজের ভূমিকা খর্ব হতে থাকে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, গত এক দশকে ভারতে সামাজিক অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নিরাপত্তা এবং ব্যক্তি সুরক্ষার রেখাচিত্র নিম্নগামী।

body_091818045721.jpg১৯৪১ সালে ১১টি দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ছিল, বর্তমানে ১৯২টির মধ্যে ১২৫টির মতো দেশে গণতান্ত্রিক শাসন রয়েছে [ছবি: রয়টার্স]

গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের শাসন ব্যবস্থার মধ্যেই এই ছবি লক্ষ করা যাচ্ছে। এই ছবি মাথায় রেখেই বহু দশক আগে বারটোল্ট ব্রেখটের প্রশ্ন ছিল, "সব ক্ষমতাই জনতার কাছ থেকে আসে। কিন্তু সেই ক্ষমতা যায় কোথায়?" বর্তমান বিশ্বে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যে যে রাজনৈতিক শব্দবন্ধ তোলপাড় তুলেছে তা হল 'পপুলিজম' বা স্বঘোষিত জনস্বার্থরক্ষক। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক ওয়ার্নার মুলার তাঁর সুচিন্তিত ও সুগভীর মতবাদ নিয়ে যে বইটি লিখেছেন তার নাম হল 'হোয়াট ইজ পপুলিজম'। যে বইটি বিদ্বৎসমাজে সাড়া ফেলেছে।

সেই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম কথাটিই হল: "একটা ভূত সারা বিশ্বকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে:পপুলিজম" ওই বইয়ে বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইভান ক্রাস্তেভকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, "আমরা পপুলিজমের যুগে বসবাস করছি।"

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অধিকাংশ দেশ তুরস্ক, ভেনিজুয়েলা ও ভারতে এখন পপুলিস্টরাই সরকারে আছেন বলে মত মুলারের। তাঁর মতে, পপুলিস্ট সরকারে শাসনে বিরুদ্ধ স্বর ও সুশীল সমাজের ভূমিকা খর্ব হচ্ছে কারণ এই সরকার মনে করে তার কোনও পদক্ষেপকেই সমালোচনা করা যাবে না। কারণ, তারা যা করছে তা তো মানুষ চাইছে বলেই করছে।

মুলার দেখিয়েছেন আগের ধারণা অনুযায়ী পপুলিজম বা বর্তমান পপুলিস্ট নেতানেত্রীর ধারণাকে বিচার করলে ভুল হবে। নতুন প্রজন্মের পপুলিস্ট নেতারা মনে করেন মানুষের ভালো করার জন্য তাঁরা যখন রয়েছেন তখন আর অন্যের প্রয়োজন কোথায়। এই মতবাদ থেকেই বিরোধী কণ্ঠকে দাবিয়ে রাখার প্রচেষ্টা শুরু। এই কারণেই মুলার বলেছেন, "পপুলিস্টরা সর্বদাই বহুমতের বিরোধী: পপুলিস্টরা মনে করেন যে তাঁরাই, কেবলমাত্র তাঁরাই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন।"

body1_091818050016.jpg৭৮ থেকে ২০১২ অবধি ভারতে সুশীল সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এর পর সুশীল সমাজের ভূমিকা খর্ব হয় [ছবি: পিটিআই]

বর্তমান বিশ্বে যে আর্থিক মন্দা, বেকারত্ব, মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তার মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি। এই পরিস্থিতির থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই নতুন প্রজন্মের পপুলিস্ট নেতানেত্রীদের উত্থান। একদিকে তাঁরা যেমন সোনালি ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, অন্যদিকে দেশে আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার জন্য দায়ী করছেন ভিন দেশ থেকে আসা ভিনধর্মের মানুষদের।

পূর্বে ও পশ্চিমে দেশগুলোতে তাই এখন অভিবাসীদের উপরেই যাবতীয় দোষ চাপানো হচ্ছে। লক্ষ্যণীয় হল, দক্ষিণপন্থী পপুলিজম যেমন রয়েছে তেমনি গ্রিস, ভেনেজুয়েলা-সহ বেশ কয়েকটি দেশে বামপন্থী পপুলিজমও রয়েছে।

এই অবস্থাকে ব্যাখ্যা করে মুলার বলেছেন, "এটি কখনোই গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ লক্ষণ নয়। যে সর্বাঙ্গীন মতবাদ গণতন্ত্রের আদর্শকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দিতে পারে বর্তমানে তা আর গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক নয়। গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক হল পপুলিজম -- এ হল এমন এক হীনহত গণতন্ত্র যেখানে সেরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।"

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

BISWAJIT BHATTACHARYA BISWAJIT BHATTACHARYA

Veteran journalist. Left critic. Political commentator.

Comment