পাকিস্তান থেকে বেকারত্ব, যে পাঁচটি ইস্যু নিয়ে দলগুলোর মধ্যে লোকসভা নির্বাচনে লড়াই হবে

সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বিজেপি, তাই বলে বিরোধীদের সব কিছুই শেষ হয়ে যায়নি

 |  5-minute read |   11-03-2019
  • Total Shares

জাতীয় নির্বাচন কমিশন সরকারি ভাবে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২০১৯ সাধারণ নির্বাচনের ঘণ্টা বেজে গেল।

আসন্ন লোকসভা নির্বাচন ১১ এপ্রিল থেকে ১৯ মে পর্যন্ত মোট সাত দফায় অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের ফলাফল ২৩ মে ঘোষণা করা হবে।

একবার দেখে নেওয়া যাক, এই নির্বাচনের লড়াইটা কোন কোন পাঁচটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে হবে। আর, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর কাছে এই ইস্যুগুলোর গুরুত্ব কতটা।

জাতীয় নিরাপত্তা

১৪ ফেব্রুয়ারী কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে যে জঙ্গিহামলা হল তা লোকসভা নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনাগুলোকে অনেকটাই বদলে দিয়েছিল। আদতে, এই জঙ্গি হামলাই এই নির্বাচনের মুখ্য ইস্যু হয়ে উঠেছিল। চল্লিশজন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যদেহের ছবি দেখে গোটা দেশজুড়ে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠী জৈশ-ই-মহম্মদ এই কাপুরুষোচিত হামলার দায়ে স্বীকার করে নেওয়ার পর আসমুদ্রহিমাচল পাকিস্তানের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রত্যাঘাতের দায়িত্ব নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। পুলওয়ামা হামলার ১২ দিনের মাথায়, মানে ২৬ ফেব্রুয়ারী, পাকিস্তানের জঙ্গি শিবিরগুলোর উপর আকাশ পথে আক্রমণ করে ভারতীয় বায়ুসেনা। আর, এই এয়ার স্ট্রাইকের ফলে, আপামর ভারতীয়রা মনে করেছিল যে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের উপর বদলা নেওয়ার কাজটা সম্পন্ন হল। সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপে দেশের জনগণ যারপরনাই গর্ববোধ করেছিল।

body_031119030921.jpgপুলওয়ামার জঙ্গিহামলা পরে রাজনৈতিক চিন্তাধারার অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে [ছবি: রয়টার্স]

২০১৪ সালে, মোদীর প্রধানমন্ত্রীর আসন দখলের প্রধান কারণ - সেই সময় গোটা দেশ একটি শক্তিশালী নেতৃত্বের খোঁজ করছিল।

নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার ঠিক আগেই ভারত প্রত্যাঘাত করায় জনগণ মনে করছে যে একমাত্র মোদীই পারেন পাকিস্তানকে যোগ্য জবাব দিতে এবং পাকিস্তানের মাটি থেকে সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করতে।

কংগ্রেস ও বিরোধীরা এয়ার স্ট্রাইকের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। এই প্রশ্ন তোলার ফলে বিরোধী শিবির কিন্তু বিভিন্ন মহলের ক্ষোভের মুখে পড়েছে। মনে করা হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থের উর্দ্ধে উঠে রাজনীতি করছেন বিরোধীরা। পাশাপাশি, বিজেপি নেতৃত্বও যে এয়ার স্ট্রাইক নিয়ে রাজনীতি করে চলেছেন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।

কাশ্মীর

পাকিস্তান মনে করে, ভারতের বিরুদ্ধে হওয়া জঙ্গি আক্রমণগুলোকে মদত দেওয়া মানে কাশ্মীরের জন্য ন্যায্য লড়াই করা। ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন কাশ্মীর থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে 'অপারেশন অল-আউট' অভিযান শুরু করেছিল তখন থেকেই কাশ্মীরের পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিল।

পুলওয়ামা জঙ্গিহামলা সেই ইস্যুটিকে আবার খবর শিরোনামে নিয়ে চলে এল। লোকে মনে করছে, একমাত্র মোদী সরকারই কাশ্মীর ইস্যুকে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। অনেকেই আবার মনে করে, কংগ্রেস এই ইস্যুটিকে নিয়ে অহেতুক 'ছেলেখেলা' করেছে যার ফলে এই সমস্যার কোনও সুরাহা করা সম্ভব হয়নি।

body1_031119031015.jpgনির্বাচনী আলোচনার মূলস্রোতে ফিরে এসেছে কাশ্মীর সমস্যা [ছবি: রয়টার্স]

জামাত-ই-ইসলামির মতো জঙ্গি সংগঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা কিংবা হুরিয়ত নেতাদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য অনেকেই মোদী সরকারকে বাহবা দিয়েছেন। এই কারণগুলোর জন্য মোদী হয়ত দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়ে যেতে পারেন।

তবে, এর পাশাপাশি আরও দুটি চিন্তার কারণ রয়েছে। এক, বেশি মাত্রায় কাশ্মীরি তরুণরা সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোতে যোগ দিচ্ছে। দুই, কাশ্মীরি পন্ডিতদের সমস্যার সমাধান হয়নি। এই দুটি কারণের জন্য মোদী সরকার কিছুটা হলেও ব্যাকফুটে রয়েছে।

মোদী বনাম বিরোধী মুখ

এই নির্বাচনটি এমন একটা সময়ে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে যখন জনগণের জাতীয়তাবোধ একেবারে তুঙ্গে রয়েছে। জনগণ এমন একটি নেতৃত্বের খোঁজ করছে যে নেতৃত্ব শুধুমাত্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত করবে না, গোটা বিশ্বে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষমতাকেও তুলে ধরবে। বিরোধী শিবিরে সেরকম কোনও বিশ্বাসযোগ্য মুখের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। আর, তাই প্রধানমন্ত্রীর আসনটির জন্য একমাত্র পছন্দ হিসেবে মোদীকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

body2_031119031118.jpgমোদীকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো যোগ্য মুখের অভাব রয়েছে [ছবি: রয়টার্স]

তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বহুজন সমাজ পার্টির মায়াবতী, তেলাঙ্গনা রাষ্ট্র সমিতির (টিআরএস) কেসিআর - কেন্দ্রে জোট সরকার এলে আঞ্চলিক দলগুলোর বহু নেতা-নেত্রীরাই এখন 'বড়' ভূমিকা পালনের স্বপ্ন দেখছেন।

তবে, জোট সরকারকে নেতৃত্ব দেবে কে, এই অনিশ্চয়তা কিন্তু বিজেপি শিবিরকেই সাহায্য করবে।

কর্মসংস্থান ও কৃষক সমস্যা

একটি ইস্যু মোদী সরকারকে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে দেলে দিতে পারে - কর্মসংস্থান সমস্যা। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারার জন্য মোদীকে ইতিমধ্যেই তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে। এই ব্যর্থতা ঢাকার জন্য ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে - এমন অভিযোগও মোদীর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে।

ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিসের সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, গত চার দশকে ভারতের বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ সীমায় এসে পৌঁছিয়েছে।

এনএসএসও-র সমীক্ষায় বলা হয়েছে ২০১৭-১৮ সালে দেশে বেকারত্বের হার ৬.১ শতাংশ, যা ২০১১-১২ আর্থিক বছরে ২.২ শতাংশ ছিল।

সরকার অবশ্য দাবি করেছে যে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতি এতটাই হয়েছে যে খুব শীঘ্রই ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করছেন, এই হিসেবের সঙ্গে বেকারত্বের হারের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

যে দেশের পঞ্চাশ শতাংশ নাগরিকের বয়স পঁচিশের কম এবং ৬৫ শতাংশের নাগরিকের বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি সে দেশের কর্মসংস্থানের অভাব কিন্তু সরকারের উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

body3_031119031232.jpgভারতীয় অর্থনীতি কি সত্যি সত্যিই বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠতে পারবে [ছবি: রয়টার্স]

কর্মসংস্থানের পরিস্থিতির জন্য ভোটাররা কিন্তু মোদীর বিকল্পের কথা ভাবতে পারে। সমস্যাটা হচ্ছে, বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকেও কোনও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। সুতারং, মোদীর বিকল্প প্রায় নেই বললেই চলে।

দেশের কৃষিশিল্পের হালও বেশ খারাপ। রাজনৈতিক দলগুলো, নির্বাচনী মরসুমগুলোতে, শুধুমাত্র কৃষকদের ঋণ মকুবের কথা ঘোষণা করে নিজেদের দায় এড়িয়ে যায়। কিন্তু এই ধরণের ঋণ মকুব প্রকল্পগুলো কৃষকদের দুর্দশা দূর করতে পারেনা। বরঞ্চ, এই প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করে।

গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে কৃষকরা বিজেপি সরকারের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে কংগ্রেসের অনুকূলে ভোটদান করেছিল। এই ক্ষোভ কি আসন্ন লোকসভা নির্বাচনেও দেখা যাবে?

সম্প্রতি চালু হওয়া প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি যোজনা প্রকল্পে কৃষকরা বছরে ছ'হাজার টাকা করে পাবে। এই টাকা কৃষকদের হাতে পৌঁছাতে শুরু করে দিয়েছে। এর ফলে কি বিজেপি কিছুটা লাভবান হবে?

এর উত্তর ২৩ মে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার দিনেই জানা যাবে।

রাফেল

কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী রাফাল বিতর্ককে বড় ইস্যু তৈরি করে ফেলেছেন। ন্যাশনাল হেরাল্ড এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছিল - রাফাল: মোদীর বোফোর্স।

বিজেপি ও মোদীর উপর এই বিতর্ক নিয়ে একের পর এক আক্রমণ করে গিয়েছেন রাহুল গান্ধী। কিন্তু এই আক্রমণের যৎসামান্যই প্রভাব পড়েছে। প্রথমত, মোদীকে একজন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। লোকে বিশ্বাস করে, তিনি কোনও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়বেন না। দুই, সামরিক চুক্তিগুলো এতটাই গোলমেলে যে লোকে এই ধরণের চুক্তিগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে চায়না।

body4_031119031313.jpgরাফাল বিতর্কের প্রভাব সাধারণ নাগরিকদের উপর খুব একটা পড়বে না [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]

রাফাল ছাড়া মোদীর বিরুদ্ধে আর অন্য কোনও কেলেঙ্কারির অভিযোগ নেই, যা দিয়ে বিরোধী শিবির তাঁকে বিদ্ধ করতে পারে।

পরিস্থিতি যা তাতে মনে হচ্ছে নির্বাচনের ফলাফল মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির অনুকূলেই যাবে। কিন্তু, তাই বলে, কংগ্রেস কিংবা বিরোধীদের জন্য সব কিছু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। এই দলগুলো যদি কৃষক সমস্যা বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর প্রতিকার খুব দ্রুত জনগণের সমানে তুলে ধরতে পারে তাহলে তারাও কিন্তু এই 'বিজেপি -বনাম অন্যান্য দলগুলোর' লড়াইয়ে বিজেপিকে কঠিন চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Comment