ভারত-মার্কিন ২+২ আলোচনায় কেন মনে হচ্ছে নতুন দিল্লি সুপার পাওয়ার হচ্ছে
এই বৈঠকে ষ্পষ্ট যে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক মজবুত হচ্ছে
- Total Shares
ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ২+২ বৈঠকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ইতিবাচকই দিকেই এগোচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বদান্যতাতেই। যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছোটখাটো ব্যাবাপেরও মতবিরোধ দেখা যাচ্ছিল সেখানে এই ধরনের একটি বৈঠক আয়োজন করা খুবই মুশকিল ছিল।
দুটি দেশ অবশ্য শেষ পর্যন্ত এই বৈঠক করতে পেরেছে। এ জন্য অবশ্যই মোদী সরকারকে কৃতিত্ব দিতে হবে, কারণ তারা কমকাসা বা কমিউনিকেশনস কমপ্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্টকে ভোট পর্যন্ত শিকেয় তুলে রেখে দিয়েছে। তার পরে তারা এই ঝুঁকি নিয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন একটা সময়ে দরকারি এই চুক্তিটি করেছে যখন ভারত-চিন সম্পর্ক নতুন করে গড়তে হবে বলে মনে করা হচ্ছে এবং আগামী মাসেই নতুন দিল্লি সফরে আসছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্রাদিমির পুতিন।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কথাবার্তা শুরু হল (ছবি:রয়টার্স)
বলিষ্ঠ সম্পর্ক
উদ্বোধনী বৈঠকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সহযোগিতা ও বাণিজ্যিক বন্ধন থেকে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন বিষয় এমনকী নিউক্লিয়ার সরবরাহকারী গোষ্ঠীতে ভারতের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে দুই দেশের আলোচনা হয়েছে। দুই দেশই একসুরে পাকিস্তানের প্রতি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছে এবং খোলাখুলি ভাবে আফগানিস্তানের মাটিতে আফগানিস্তানের নেতৃত্বে ও আফগানিস্তানের নিজের মতো করে সবচিখু মিটমাট করে নেওয়ার পক্ষে সুর চড়িয়েছে। ইরান ও রাশিয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে মতবিরোধ করেছে তা সুচারু ভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এই বৈঠকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেশ আশ্চর্যজনক সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে ভারত। একদিকে যখন কথা হচ্ছে যে ওয়াশিংটনের ব্যাপারে তেমন গুরুত্বই দেওয়া হচ্ছে না, তখন অন্যদিকে ওয়াশিংটন মনে করেছে যে বড্ড বেশি সমালোচনা হচ্ছে তাদের ব্যাপারে। আসল কথাটি হল, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক রদবদলকে পাত্তা না দিয়ে আগামী বেশ কিছুদিন অন্তত দুই দেশের সম্পর্ক ইতিবাচাক পথ ধরে দ্রুত এগিয়ে চলবে। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – দুই দেশেরই শীর্ষ নেতৃত্ব রাজনৈতিক পরিচয় সরিয়ে রেখে এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক।
এমনকী ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্বেও দেখা যাচ্ছে যে তিনিও ভারতের ব্যাপারে ভালো কথাই বলছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বলেছেন যে বারাক ওবামার সময় পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে যে দ্বিধার ইতিহাস ছিল তাও এখন কেটে গিয়েছে। ট্রাম প্রশাসনের গোড়ার দিকই তিনি বলেছিলেন যে, “আমার লক্ষ্য হল ‘নতুন ভারত’ এবং রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের লক্ষ্য হল আমেরিকার আরও সুন্দর করে গড়ে তোলা আর এটাই আমাদের দুই দেশের সহযোগিতাকে অন্য মাত্রা এনে দেবে।”
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া নীতি ভারতকেও গুরুত্ব দিচ্ছে (ছবি: পিটিআই)
জর্জ ডব্লিউ বুশ যে বলেছিলেন তিনি ভারতকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করবেন, মোদীও ভারত-মার্কিন সম্পর্কে সেই খাতেই প্রবাহিত করার জন্য ট্রাম্পকে বোঝাতে সক্ষম হন। ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া নীতির মধ্যে ভারতকে তিনি অন্তর্ভুক্ত করান এবং তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক শব্দবন্ধের উপরে জোর দেন ও ভারতের ব্যাপারে ভাবনার তার বেঁধে দেন।
ভারত-মার্কিন সম্পর্কের মধ্যে সমস্যা রয়েছে, কোনও সমস্যা নগন্য আবার কোনওটা বেশ গুরুতর। ইরান নিয়ে প্রশ্নটি দীর্ঘদিনের, এ ব্যাপারে ভারত-সহ প্রতিটি দেশের সঙ্গেই আলাদা করে কথা বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তারা চাইছে ৪ নভেম্বরের মধ্যে ইরান থেকে তেল আমদানি পুরোপুরো বন্ধ করে দিক সব রাষ্ট্র।
যদি ভারত তা করতে ব্যর্থ হয় তা হলে ভারতীয় সংস্থাগুলোর উপরে নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে আসবে। ইরানের ব্যাপারে কঠোরতম অবস্থান গ্রহণ করেছে ট্রাম্প প্রসাসন এবং এ ব্যাপারে তারা কোনও কিছুর সঙ্গেই বিন্দুমাত্র আপোস করবে না।
রুশ সম্পর্ক
ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সমঝোতা হল আরেকটা চিন্তার বিষয় কারণ রাশিয়ার থেকে ভারত ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য এস৪০০ কেনার ব্যাপার কথাবার্তা বলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে “কাউন্টারিং আমেরিকাজ অ্যাডভারসরিজ থ্রু স্যাংশনস অ্যাক্ট” বা কাস্টা অনুযায়ী কোনও দেশ যদি রাশিয়ার ৩৯টি সংস্থার কোনও একটির সঙ্গেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কিছু লেনদেন করে সেই দেশের উপরেও নিষেধাজ্ঞা বলবত হতে পারে। প্রতিরক্ষার ব্যাপারে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং ভারতের প্রতিরক্ষা রাশিয়ার উপরে অনেকটাই নির্ভরশীল –প্রযুক্তি সংক্রান্ত কৌশলগত সহযোগিতা থেকে যন্ত্রাংশ সরবরাহ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ এবং খুঁটিনাটি বিভিন্ন ব্যাপারে।
ত্রিপাক্ষিক ব্যাপারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বেগের ব্যাপার হল বাণিজ্য, ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে নতুন দিল্লি তার বাণিজ্য সংক্রান্ত বাধা কমিয়ে ফেলুক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও কোনও পণ্যের উপরে ১০০ শতাংশ হারে শুল্ক ধার্য করা নিয়ে (অন্য কয়েকটি অর্থনীতির পাশাপাশি) ভারতকেও অভিযুক্ত করেছে ট্রাম্প প্রশাসন এবং এই সব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকিও দিয়েছে। ভারত থেকে আমদানি করা ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বৃদ্ধি করার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৯টি পণ্যের উপর থেকে আমদানি শুল্ক ৪ অগস্ট থেকে হ্রাস করার কথা ঘোষণা করেছে ভারত, এই পণ্যগুলির মূল্য ২৩.৫০ কোটি মার্কিন ডলার।
বহু বিষয়েই ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপরীত অবস্থানে থেকেছে (ছবি: রয়টার্স)
আস্থা বাড়ানোর উপরে জোর
এই সবকটি বিষয় মিলিত ভাবে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিতক সম্পর্কে আবার সেই পারষ্পরিক দোষারোপ ও বিবাদের সেই সব পুরোনো দিনকে ফিরিয়ে আনতে পারে। তবে চিরকালই এমন অনেক বিষয়ই ছিল যেখানে ভারত ও আমেরিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থানে থেকেছে। এমনকি যখন ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্কি সই হচ্ছে তখনও অত্যুৎসাহী অনেক দেশই এই প্রক্রিয়া ভেস্তে দেওয়ার জন্য ভারত ও ইরানের মধ্যে যে চুক্তি রয়েছে তা নিয়ে সরব হয়েছিল। আজ যখন ইরান ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তখন ভারতই যে একমাত্র দেশ নয় যাকে আমেরিকা টার্গেট করেছে। তিনটি বিবষয়কে যোগ করেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বারত যে তার মূল লক্ষ্য, এমন নয়।
রাশিয়ার ব্যাপারটা একেবারে আলাদা, ট্রাম্প প্রশাসন এ নিয়ে তাদের সংসদের নিম্নকক্ষে ভারতের সমর্থনে বলেওছে, তা ছাড়া এই ব্যাপারে ভারতকে অব্যাহতি দেওয়ার পক্ষেও তারা বলেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কাজের যা পদ্ধতি এবং গতিপ্রকৃতি তাতে ভারত-মার্কিন সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন হচ্ছে বটে, তবে নতুন দিল্লিও প্রত্যয়ের সঙ্গে সম্পর্কের মূল ভিত্তি একই রকম দৃঢ় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ভারত যে নিজেকে উদীয়মান শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয়ী, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে উপযুক্ত পথে চালিত করতে ভারতকেই উদ্যোগী হতে হবে, তাকে আশপাশের কথায় কান দিলে চলবে না। যদি ২+২ আলোচনায় কোনও একটি দিক নির্দেশিত হয়ে থাকে তা হল ভারত এই কৌশল খুব দ্রুত রপ্ত করছে।
(সৌজন্য: মেল টুডে)
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

