সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছে রাজ্যের শাসকদলই!
৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী শাসকদল তৃণমূল
- Total Shares
বিরোধীরা অভিযোগ করছিলেন, পঞ্চায়েত ভোটকে প্রহসনে পরিণত করেছে রাজ্যের শাসকদল, মনোনয়নই জমা দিতে দিচ্ছে না। আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, রাজ্যে গণতন্ত্র না থাকলে বিরোধীরা ৯৬,০০০ প্রার্থী দিতে পারত না। আবার নতুন করে দুই পক্ষের বলার সময় হয়ে এল বলে। রাজ্যে মোটামুটি ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। আর পরিসংখ্যান বলেছে, সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছে রাজ্যের শাসকদলই!
এ বারে পঞ্চায়েত নির্বাচনে সব সিদ্ধান্তই হচ্ছে আদালতের হস্তক্ষেপে, শুধু ফলাফলটা নিজের হাতে রেখেছে শাসকদল। কেউ যদি নিজে পরীক্ষা দিয়ে নিজেই নিজেকে নম্বর দেয়, তা হলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সোভিয়েত দেশে টিনটিনে যে ভাবে ভোট হয়, অনেকটা সেই আদলে ভোট হয়েছে বীরভূমে।
মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, রাজ্যে গণতন্ত্র না থাকলে বিরোধীরা এত আসনে প্রার্থী দিতেই পারত না। কিন্তু মনোনয়ন পেশের দিন শেষ হতে দেখা গেল, রাজ্যে গ্রামপঞ্চায়েতের ৪৮,৬৫০টি আসনের মধ্যে ১৬,৮১৪টি আসনে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। এর মধ্যে একটি করে আসনে বিজেপি ও সিপিএম জিতলেও, বাকি ১৬,৮১২টি আসনে জিতেছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। অর্থাৎ ৩৪.৫৬ শতাংশ গ্রামপঞ্চায়েত আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তারা। পঞ্চায়েত সমিতিতেও অবস্থা প্রায় একই, ৯২১৭টি আসনের মধ্যে ৩০৫৯টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস, শতকরা হিসাবে ৩৩.১৯। জেলা পরিষদে ৮২৫টি আসনের মধ্যে ২০৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল, মানে মাত্র ২৪.৬ শতাংশ আসনে।
মনোনয়ন পর্বে দেখা গিয়েছে, গ্রামপঞ্চায়েতে ৪৮,৬৫০টি আসনের মধ্যে ৫৮,৯৭৮ জন প্রার্থী হতে চেয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে! মানে ১০,৩২৮ জন প্রার্থী বেশি। গ্রাম পঞ্চায়েতে ৯২১৭ আসনে তৃণমূলের প্রার্থী রয়েছেন ১২,৫৯০ জন, মানে ৩,৩৭৩ জন বেশি। জেলা পরিষদে ৮২৫ আসনে ১০০০ জন তৃণমূল প্রার্থী রয়েছেন। মানে ১৭৫ জন বেশি। অর্থাৎ বিরোধীপা যখন প্রার্থী দিতেই পারছে না, তখন রাজ্যে শাসকদলের প্রার্থী উপছে পড়ছে, অর্থাৎ, বিভিন্ন আসনে যখন বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারছে না, তখন শাসকদলের গোষ্ঠীকোন্দলে একই আসনে একাধিক প্রার্থী।
এ বার শুরু মনোনয়ন প্রত্যাহার। গ্রাম পঞ্চায়েতে ১০,৩২৮ জন বাড়তি প্রার্থীর মধ্যে তৃণমূল প্রত্যাহার করল ৭,০৩৩ জনকে, বাকিরা রয়ে গেলেন। পঞ্চায়েত সমিতিতে ৩,৩৭৩ জন বাড়তি প্রার্থীর মধ্যে ২৪০৭ জন এবং জেলা পরিষদে বাড়তি ১৭৫ জনের মধ্যে ১৩৪ জন তৃণমূল প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতে পেরেছে দল। তাই বহু আসনে এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৃণমূল বনাম তৃণমূল। সরকারি দলও জানিয়ে দিয়েছে, যে জিতবে তাকেই দলে নেবে তৃণমূল।
প্রথমে মনোনয়নপত্র জমাই দিতে পারছিল না বিরোধীদলগুলি
একই আসনে নিজেদের দলের একাধিক প্রার্থী থাকায় যখন তৃণমূল প্রার্থী প্রত্যাহার করছে, তখন বিরোধী দলের অবস্থাটা একেবারেই ভিন্ন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী যে বলেছেন, রাজ্যে বিশেষ করে মহিলা প্রার্থীদের ভয় দেখিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করানো হচ্ছে, তা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণও মিলছে সংবাদমাধ্যমে। সর্বশেষ সংযোজন নদিয়ার ঘটনা। সেখানে সন্তানসম্ভবা বিজেপি প্রার্থীকে মারধর ও শ্লীলতাহানি করেছে দুষ্কৃতীরা, অভিযোগ, তারা তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত।
প্রথমে মনোনয়নপত্র জমাই দিতে পারছিল না বিরোধীদলগুলি। তা নিয়ে একপ্রস্থ নাটক, মনোনয়নের দিন বাড়ানোর কথা রাতে ঘোষণা করে সকালে তা প্রত্যাহার করে নেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার অমরেন্দ্র কুমার সিং। আদালতের হস্তক্ষেপে বিরোধীরা এক দিন সময় পেলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি।
জেলা পরিষদ স্তরেই বিজেপির মোট ১৫৩ জন মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন, যে সংখ্যাটা তৃণমূলের চেয়েও বেশি। তার পরেই রয়েছে সিপিএম (৭৯), কংগ্রেস (৫৪) নির্দল (৩২)। পঞ্চায়েত সমিতিতে ৯৩১ জন বিজেপি প্রার্থী প্রত্যাহার করেছে, তার পরেই রয়েছে সিপিএম (৫৫৮) ও কংগ্রেস (৩০১)। নির্দল ৩৭০ জন প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করেছেন। গ্রামপঞ্চায়েত স্তরে ৪৪৯০ জন বিজেপি প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। তার পরেই রয়েছে সিপিএম (২৪৯০), কংগ্রেস(১৩৮৩) ও নির্দল (২৫৫৯)।
বিরোধীদের অভিযোগ, শাসকদলের সন্ত্রাসেই মনোনয়ন দাখিল করা যায়নি, অনেকে বাধ্য হয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন।
এ রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের একটাই রীতি, শাসকদল বহু আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়। নন্দীগ্রামের পরে যখন পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল, তখনও কিন্তু অধিকাংশ আসনেইহয় জিতেছিল শাসকদল, বহু বোর্ঝ ছিল ত্রিশঙ্কু। কিন্তু এক তৃতীয়াংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজ্যের শাসকদলের জয়ে প্রশ্ন উঠছে, জনগণের হয়ে এ রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে রায় কি চিরকাল শাসকদলই দেবে!

