প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন ভারত কেন তাঁদের সম্মান জানায়নি
কারণ লুকিয়ে গান্ধীর দোটানা, নেহরুর দ্বেষ ও তিক্ত ঔপনিবেশিকতার মধ্যে, তা থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে
- Total Shares
জার্মানির আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পনের মাধ্যমে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল তখন এই বিশ্বযুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা ছিল চার কোটি (২ কোটি হত এবং বাকিরা আহত), দীর্ঘ ও ভয়ানক যুদ্ধ শেষে অন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে তারা দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশাল আয়োজন করেছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বকেই পুরো বদলে দিয়েছে (ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস)
যুদ্ধশেষের বিউগল বাজার পরে আরও একশোটা বছর আমরা পার করে ফেললাম এবং সেই ঘটনা ইতিহাসের অধ্যায়ে এখন আবদ্ধ হতে চলেছে।
তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা ঔপনিবেশিক ভারতেরও বিশাল ভূমিকা ছিল যদিও সেই যুদ্ধে যে ১৫ লক্ষ ভারতীয় সেনা লড়াই করেছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে যে ৭৪ হাজার সেনার মৃত্যু হয়েছিল আমরা তাঁদের কথা ভুলেই গিয়েছি। হাজার হাজার ভারতীয় সেনা আহত হয়েছিলেন, অনেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন। ভারতীয় সেনাদের বড় অংশকে নিযুক্ত করা হয়েছিল ফ্ল্যান্ডার্স (বেলজিয়াম), পূর্ব আফ্রিকা, গ্যাল্লিপোলি, এডেন, মিশর, ইরাক, প্যালেস্তাইন, পারস্য ও চিনে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সৈনিকদের বিপুল অবদান ছিল এবং তার পুরোটাই বিস্মৃত (ফোটো: ইন্ডিয়াটুডে)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় ফৌজিদের এই অবদানের কথা সার্বিক ভাবে ভুলেই গিয়েছে স্বাধীন ভারত – এই একই কথা বলা যেতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রেও – এই বিশ্বযুদ্ধে ৮৭,০০০ ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয় এবং হতাহতের মোট সংখ্যা ছিল ৬ কোটি। ফিল্ডমার্শাল অচিনলেক, যিনি ১৯৪২ সালে ভারতীয় সেনাধ্যক্ষ (কমান্ডার-ইন-চিফ) ছিলেন, তিনি বলেছিলেন “এই দুই যুদ্ধ (প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) লড়াই যেত না যদি ভারতীয় সেনা না থাকত।”
এঁদের মতদ্বৈতের জন্যই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শহিদদের আমরা বিস্মৃত হয়েছি (ফোটো: ইন্ডিয়াটুডে)
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পরে এ কথা ভুলে যাওয়া হল কারণ এই দুই মহাযুদ্ধের মাঝে গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের যে স্বাধীনতা সংগ্রাম তার সঙ্গে এই সেনানীদের অবদানও যুক্ত হতে পারে, সেই কথা মনে করে। অহিংসাই ছিল শাশ্বত সত্য আর তলোয়ার এবং বন্দুকের লড়াই ছিল অভিশাপ। এর উপরে আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই জালিয়ানওয়ালাবাগে ভারতীয় সেনাদের গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটেছিল – যা সামগ্রিক ভাবে ভারতীয় মানসে তীব্র আতঙ্ক ও গভীর যন্ত্রণা সৃষ্টি করেছিল।
স্বাধীন ভারতে সামগ্রিক ভাবে প্রতিষ্ঠান হিসাবে সেনাদের অবদানের কথা স্মরণ না করার আরও একটা কারণ হল প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিদ্বেষ যদিও ভারতীয় সেনাদের মধ্যে ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ছিলেন তাঁর কাছে ব্যতিক্রমী, হয়তো একমাত্র তাঁর প্রতিই নেহরুর কোনও বিদ্বেষ ছিল না।
সেনাদের মধ্যে একমাত্র লর্ড মাউন্টব্যাটেনকেই কি সহনীয় বলে মনে করতেন নেহরু? (ফোটো: ইন্ডিয়াটুডে)
একই সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কয়েকজন বরিষ্ঠ সেনা আধিকারিকের এক্তিয়ার লঙ্ঘন করে পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রবেশও এর কারণ হয়ে থাকতে পারে। বিভিন্ন অঞ্চলে তখন যা পরিস্থিতি ছিল সেটিও উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছিল যে কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনা আধিকারিক হয়তো ক্যু করে বসবেন – এই চাপা আতঙ্ক তখন ভারতের আমলাতন্ত্রের ভিতরে জাঁকিয়ে বসেছিল বিশেষ করে তখন রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য রূপান্তরিত হচ্ছে তিরঙ্গার প্রতি আনুগত্যে।
আরও একটা কারণে ভারতীয় সেনাদের অবদানকে প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তা হল নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজ (আইএনএ) যার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যোগ ছিল জার্মানি ও জাপান – দুই দেশেরই।
সম্প্রতি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী
এ জন্যই স্বাধীনতার পরে দশকের পর দশক ধরে সরকারি ভাবে ভুলে থাকা হল সেনাদের সব ধরনের সাফল্যের কথা। ১৯৪৭ সালের আগে বিদেশের মাটিতে ভারতীয় সেনাদের সমস্ত বীরগাথা ভুলে থাকা হত আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও আমরা সেই ভুলে থাকার অভ্যাস থেকে নিজেদের বার করে আনতে পারিনি – তা সে ১৯৫৩ সালে কোরিয়ার যুদ্ধবিরতির সময়ের কথা হোক (সেনাপ্রধান টিম্মায়া) বা ১৯৯২ সালে যুগোস্লাভিয়ায় শান্তিসেনার কথা হোক (সেনাপ্রধান থাম্বিয়ার) – সে সব কথাই আমরা ভুলেছি, যদিবা সে সব কথা কখনও স্মরণও করা হয়, সব কিছুই বলা হয় রেখেঢেকে যেখানে সাধারণ মানুষ নেই বা জাতীয় প্রসংশার কোনও প্রশ্ন নেই।
নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে ভারতীয় সেনাদের প্রতি এই ধরণের উদাসীন মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে – তাই যখন দেখা গেল যে ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ভারতের রাষ্ট্রপতি (তখন ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের উদ্দেশে ইন্ডিয়া গেটে মাল্যদান করছেন তখন বেশ আশ্চর্যই লেগেছিল।
মোদীর শাসনকালে যাঁরা বিদেশে শহিদ হয়েছেন তাঁদের সম্মান জানাতে কিছুটা হলেও পদক্ষেপ করা হয়েছে (ছবি: পিটিআই)
এই ভাবে চলতে থাকলে এই সপ্তাহেই বিদেশের মাটিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভারতীয় সেনাদের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ উন্মোচিত হবে ফ্রান্সে, উন্মোচন করবেন উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু। দিল্লিতেও ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটে (ইউএসআই) এবং বিভিন্ন স্থানীয় উদ্যোগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার নিয়ে আলোচনাচক্র বসবে।
ঐতিহাসিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনও ঘটনাকে স্মরণ করা হয়তো একেবারেই বিষয়ভিত্তিক হয়ে যায় অথবা মাত্রাছাড়াও হয়ে যেতে পারে – সেখানে কোনও কিছুকে অতিরঞ্জিত করা হতে পারে, কোনও কিছুকে ভুলে যেতে পারি – তবে এ সব এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। সেইসব সেনানীকে স্মরণ করা যেতে পারে, সেখানে তাঁদের দেবতার আসনে বসানোর বা কোনও রকম রাজনৈতিক ফায়দা তোলা থেকে দূরে থাকা যেতে পারে, এ ব্যাপারে মধ্যবর্তী একটি অবস্থান গ্রহণ করা যেতে পারে এবং এ জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
২০২০ সালের অগস্ট মাস হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের ৭৫ বার্ষিকী এবং সেখানে নানা ধরনের রসায়নের কথা কল্পনা করা যেতে পারে – যার মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের রহস্যোদ্ঘাটন, সেই পরমাণু বোমা যা ১৯৪৫ সালের অগস্ট মাসে ফেলা হয়েছিল হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে।
এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করতে ভারও নানা পরিকল্পনা করতে পারে – তবে ঔপনিবেশিক তিক্ততার জন্য যেন সময়-ময়দানে সেই বীরগাথা ও সাহসিকতার কথা লঘু না হয়ে যায়। তখন যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবাদ কিছুটা কম থাকে তা হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভারতীয় ফৌজকে যৌথ ভাবে শ্রদ্ধাও জানানো যেতে পারে এবং তাঁদের বীরগাথা সারা বিশ্বকে জানানো যেতে পারে – সমগ্র বিশ্বের সম্মুখে তুলে ধরা যেতে পারে সেই ভারতীয় ফৌজের পেশাদারিত্বের কথা – যেখানে তাঁদের সেই রক্ত ঝরেছিল স্বাধীনতার জন্য।
দূরদেশে যুদ্ধ করে আমাদের যে জওয়ানরা শহিদ হয়েছেন, আমাদের উচিত ভালোবাসা ও গর্বের সঙ্গে তাঁদের স্মরণ করা (ছবি: পিটিআই)
যুদ্ধক্ষেত্রে যে সেনাদের জীবনতারা ঝরে পড়েছিল সেই সেনাদের কথা যে সমাজ বিস্মৃত হতে পারে, সেই সমাজ প্রকৃতপক্ষে নিজেকেই লঘু করছে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে