একাত্তরে ভারত: স্বাধীনতা সংক্রান্ত কয়েকটি গোপন তথ্য

স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের মধ্যে স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা মানে দূরদৃষ্টির অভাব

 |  4-minute read |   19-08-2018
  • Total Shares

স্বাধীনতা মানেই শুধুমাত্র ভারত নয়। কোনও নির্দিষ্ট বিষয় বা ব্যক্তি বিশেষের সঙ্গেও স্বাধীনতার সম্পর্ক থাকতে পারে। ছোটবেলায় এই কথাটি আমাকে বুঝতে দেওয়া হয়নি।

আমার মনের গভীরে কোথাও যেন এই দু'টি শব্দ একীভূত হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে একটি শব্দ নাম বাচক বিশেষ্য অন্যটি গুণবাচক বিশেষ্য - ভারত ও স্বাধীনতা। সেই সময় এই দু'টি শব্দ আমার মনে কোনও প্রভাব ফেলেনি। কারণ দু'টি শব্দই বড়দের জন্য বরাদ্দ ছিল। মাস মাহিনা কিংবা বাড়ির ঠিকানার মতো এই দু'টি শব্দ তাঁদের জীবনে গুরুত্ব পেয়েছিল।

পরবর্তী কালে এই শব্দযুগল কী রকম জানি নির্বীষ হয়ে গিয়েছিল। যখন কোনও এক বৃষ্টিভেজা আগস্টের সকাল মানেই হলুদ রঙের লাড্ডু বা সবজেটে বোঁদে সঙ্গে একটি নিস্তেজ ত্রিবর্ণ পতাকা সঙ্গে মাড় দেওয়া গঙ্গা যমুনা শাড়ি পরিহিত আমার মা, যিনি তাঁর শাড়িকে ত্রিবর্ণরঞ্জিত করে তোলার প্রচুর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন কিংবা পাড়াতুতো  কাকুর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ঠাট্টা মস্করা এবং সর্বোপরি স্কুল না যাওয়ার বাহানা।

body_081918055350.jpgস্বাধীনতা মানে শুধুমাত্র দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন নয় [ছবি: পিটিআই]

ততদিনে আমার মনের মধ্যে আরও একটি ধারণা জন্ম নিয়েছিল - আমি এখনও একজন শিশু আর আমার কাছে স্বাধীনতা মানে যত দ্রুত সম্ভব প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠা।

মৃত্যু কিংবা ভালোলাগার লোকটিকে খুঁজে বের করা সহ আরও অনেক কিছু নিয়ে তখন আমি অপেক্ষারত। কিন্তু এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার অপেক্ষাটাই সবচেয়ে দীর্ঘ। এর কারণ, কেউ জানতেই পারে না কখন সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়েছে। হটাৎ করেই একদিন সে উপলব্ধি করে যে সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছে। এ একেবারেই কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার বিজ্ঞান নয়। প্রায় ২৫ বছর হতে চলল আমি প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি। এখন আমি নিজেকে এই কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে থাকি। আবার অন্যরা আমাকে এই কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে থাকেন।

এই পঁচিশ বছরে স্বাধীনতা সম্পর্কে আমার একটি জিনিস উপলব্ধি হয়েছে। যা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারেন না। স্বাধীনতা শুধুই যেন সরে সরে যায়, তাকে কখনও স্পর্শ করা যায় না।

body1_081918055440.jpgআমি জীবনের খুব সাধারণ বিষয়গুলোর মধ্যেও স্বাধীনতা খুঁজে পেয়েছি

আমার স্কুল জীবনের শেষ দু'টি বছর কলকাতার একটি হোস্টেলে কেটেছে। আর, সেই সময় আমি জীবনের খুব সাধারণ বিষয়গুলোর মধ্যেও স্বাধীনতা খুঁজে পেয়েছি - গ্রীষ্ম বা শীতের ছুটিতে বাড়ি ফেরা, কোনও কারণ ছাড়াই নিউ মার্কেটে ঘুরতে যাওয়া, না কেনাকাটার জন্য নয়, শুধুমাত্র স্বাধীন বাতাসের স্বাদ পাওয়ার জন্য, অপরিচিতদের দেখা বা গায়ে গা ঠেকে যাওয়া, কিংবা রবিবার পাশের সেন্ট জেমস চার্চে যাওয়া, কখনও আবার বান্ধবীরা তাদের কয়্যারে গাওয়া ছেলে-বন্ধুদের জন্য ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছে।

এর থেকে আমি শিখেছি যে স্বাধীনতা হল ক্ষণস্থায়ী। তবুও মনকে কোনও ভাবেই বোঝানো যায় না, তারাও চায় পরিপূর্ণ ভাবে স্বাধীন হতে। আমি এমন একজনকেও চিনি না যিনি বুক ঠুকে দাবি করতে পারেন যে তিনি পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছেন।

ধর্ম এবং আধ্যাত্মিক অনুভূতি আমাদের আমাদের পরিপূর্ণ ভাবে স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে বাধ সেধেছে। এর মধ্যে রয়েছে দুনিয়া ও দুনিয়াদারি, উচ্চাশার আবেশ থেকে শুরু করে সর্বশেষ অবস্থা -- মোক্ষলাভ বা নির্বাণ পর্যন্ত। শিল্পকলার ক্ষেত্র অবশ্য এর খুব কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে। কখনও কখনও অবশ্য সমালোচকরা একটু কড়া ভাষাতেই তাঁদের 'মুক্তিকামী' বলে থাকেন। নির্বাণ ও পালিয়ে বাঁচা -- এই দুই ক্ষেত্রেই লোকে দুনিয়া, তাদের সমাজ এবং সবচেয়ে বড় কথা হল বাস্তবের মুখোমুখি হওয়ার হাত থেকে মুক্তি পায়। (যারা এই ভাবে মুক্তি চায় তাদের ভাষাই হল: দুনিয়াটা আমাদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে)। 

body2_081918055554.jpgপর মুহ্র্তেই আমার মনে হয় তাঁর কি সত্যিই কোনও স্বাধীনতা রয়েছে [ছবি: রয়টার্স]

আমি এমন একজনকেও চিনি না যার কাছে স্বাধীনতা নিয়ে কোনও নিজস্ব উপমা নেই। এই উপমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত হচ্ছে পাখির স্বাধীনতা। প্রচুর গানে এই উপমা ব্যবহার করতে দেখা যায়। একবার তো শান্তিনিকেতন যাওয়ার করবার সময় আমি একজন বাউলকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম - পাখি কী ভাবে স্বাধীনতা উপলব্ধি করতে পারে?

আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে স্বাধীনতা ভীষণ ভাবেই মানুষ-সম্পর্কিত। স্বাধীনতা দিবস উদযাপনকে তাই আমার বরাবরই হাস্যকর বলে মনে হয়েছে - বিষয়টা অনেকটা সন্তান জন্ম নিতেই একজন মা ও একজন বাবা হয়ে গেলেন-- এই ভাবে কি স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব?

body3_081918055731.jpgস্বাধীনতা দিবস তো রাজনৈতিক অনুষ্ঠান [সৌজন্যে: মেমোরিয়াল মিউজিয়াম এন্ড লাইব্রেরি]

জিমন্যাস্টিক করবার সময় একজন ক্রীড়াবিদ যখন শূন্যে কসরত করেন তখন আমার কেন জানি না মনে হয়, সেই ক্রীড়াবিদ স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে পারছেন। পর মুহর্তেই আমার মনে হয় তাঁর কি সত্যিই কোনও স্বাধীনতা রয়েছে?

সরল গাণিতিক হিসাবের ছাঁচে পুরোটা আমি ফেলার চেষ্টা করি-- স্বাধীনতার থাকলে তার সঙ্গে সব সময়েই উদ্বেগও থাকবে। এই উদ্বেগকে আমরা স্বাগত জানাই। কোনও কিছু খেতে গেলে যেমন মুখের লালা নিঃসরণ হওয়া বন্ধ করতে পারি না, এটাও অনকটা সেই রকম, এই দায়দাও কোনও ভাবে ঝেড়ে ফেলা যায় না।

আমিও সকলের স্বাধীনতা প্রার্থনা করে থাকি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রার্না করি গাছপালা ও জীবজন্তুর মতো মনুষ্যেতর জীবদের জন্য, পৃথিবী না জানি কত সুন্দর হত যদি এই সব জীব মানুষের শাসন থেকে মুক্ত হত।

স্বাধীনতা দিবস উদযাপন মানেই স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা -- আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতের শাসনভার ব্রিটিশরা তুলে দিল ভারতের হাতে-- স্বাধীনতা সম্পর্কে ধারণাটা যেন অনেকটা এই রকমই অকিঞ্চিকর।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SUMANA ROY SUMANA ROY

Sumana Roy is an author and a poet based in Siliguri.

Comment