স্বাধীনতার পরেও সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব: ঔপনিবেশিক মানসিকতারই প্রতিফলন

যাঁরা শিক্ষার পরিকাঠামো দিয়েছেন তাঁর নয়, আমরা পুজো করি ক্ষমতাশালীদের

 |  5-minute read |   18-08-2018
  • Total Shares

একটা গেলাস অর্ধেকটা ভর্তি না খালি এই তত্ত্বে তিনি বিশ্বাস করেন না বলে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে চাত্রদের একটা সভায় বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তাঁর কথা, গেলাসটি ভর্তিই, অর্ধেকটা জলে আর বাকি অর্ধেকটা বাতাস দিয়ে। করতালি দিয়ে সেদিন শ্রোতাদর্শকরা তাঁকে অকুণ্ঠ অভিবাদন জানিয়েছিলেন তাঁর তারুণ্য, আশাবাদী ও উদ্যমী মনোভাবের জন্য। আশাবাদী ও ইতিবাচক মনোভাবের শেষ কথা এবং তাঁর কাজ করার অভিপ্রায়, সবকিছুর মধ্যে ভালো দেখার মানসিকতা তাঁকে নির্বাচনে জয়ী করেছিল।

সদ্য স্বাধীনোত্তর ভারতে যাঁদের জন্ম, রূপকের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন কর, তাঁদের মন জয় করে নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সদ্য স্বাধীনতার পরে পঞ্চাশের দশকের নির্বাচনগুলিতে ইতিবাচক মনোভাব জাগিয়ে ও স্বপ্ন দেখিয়ে জয়ী হয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু।

তখনও ওই অর্ধপূর্ণ গেলাস ছিল, দেশের মানুষ বিশ্বাস করতেন বাকি অর্ধেকটাও একদিন পূর্ণ হবে, যদি তা খাদ্য ও পানীয়ে পূর্ণ নাও হয় তা হলে অন্তত স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে পূর্ণ হবে।

baru_1_081818042251.jpgপাত্রটি অর্ধপূর্ণ। আদৌ কি কোনও দিন পরিপূর্ণ হবে? দেশবাসী এখনও স্বপ্ন দেখে (ইন্ডিয়া টুডে)

একটা স্বাধীনতা দিবস থেকে আমরা যখন পরবর্তী স্বাধীনতা দিবসের দিকে যাই, মাঝের সময়টুকুতে আমরা শুধুই প্রশ্ন করে যেতে থাকি কবে এই অভাবের থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা উন্নয়ন ও স্বাধীনতায় পরিপূর্ণ হব। পূর্ণ গেলাসের রূপক শুনে অনেক দেশবাসীই হয়তো সন্তুষ্ট হয়ে থাকতে পরেন, তবে যদি দেশ সত্যি সত্যি কিছু করে উঠতে না পারে তা হলে তাঁদের সেই সন্তুষ্টি আর থাকবে না।

যদি দেশের বিকাশ না ঘটে তা হলে দেশ সম্বন্ধে যে কথাগুলো প্রায়ই বলা হয় -- মহান শক্তি, অন্যতন শক্তি, উদীয়মান শক্তি ও অগ্রবর্তী শক্তি – কথার কথাই থেকে যাবে। ২০১৪ সালে মোদীকে ভারত দেখেছিল উন্নয়নের মসিহা হিসাবে। তাঁকে সেই ভাবেই দেখা হবে যদি অন্তত আমাদের জীবদ্দশায় নতুন ভারতের বাস্তবায়ন হয়।

ভারতের এই কাহিনি তিনটি সরল সংখ্যার উপরে ভিত্তি করে রয়েছে – বিংশ শতকের প্রথম দিকে শূন্যের কাছাকাছি বৃদ্ধির হার, ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে ৩.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বছরে ৫.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি এবং তার পর থেকে গড়ে ৭.৫ শতাংশ হারে।

ভারতের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের এই দৃঢ় ভাবই হল সেটাই যা ওই বাকি অর্ধেকটা গেলাস ভরে দেবে।

baru_2_081818042323.jpgওরা কাজ করে: দেশের অর্থনীতির স্থায়ী উন্নয়ন ঘটছে শ্রমিকদের জন্যই (ছবি: রয়টার্স)

আরও অনেকগুলো সাদামাঠা বিষয় রয়েছে যা এই গেলাস পূর্ণ হতে সাহায্য করবে।

রাজনীতির প্রতিশ্রুতির গরম বাতাস দিয়ে আর কথার জাল বুনে, আড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা করে যদি সেই শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করা হয়, তা হলে অবশ্য কাজের কাজ কিছুই হবে না।

বিগত ৭০ বছরে সবচেয়ে বড় যে তিনটি ফাঁক রয়ে গেছে তা হল শিক্ষার প্রতি অবহেলা, শিল্পোৎপাদন ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নির্ভরতা তৈরিতে উদাসীনতা ও কৃষিক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন না ঘটাতে পারা। যাঁরা চিনের উন্নয়নের পরিসংখ্যান দেখে অবাক হয়ে যান তাঁদের জানা দরকার যে এই তিন ক্ষেত্রের ভিত্তি মজবুত করতে নির্দিষ্ট ভাবে তারা জোর দিয়েছে। একটি দেশ গণতান্ত্রিক আরেকটি দেশ কমিউনিস্ট বলে এই পার্থক্য হয়েছে এমন নয়, কারণ হল কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তরের জন্য বিনিয়োগ না হওয়া, সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা না করা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মঞ্চে দেশের শিল্পকে তুলে না ধরা। সাধারণ অধিকারটুকু বোঝার জন্য দেশ ও বিদেশের বহু অর্থনীতিবিদের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন নেই দেশের নীতি নির্ধারকদের।

প্রতি বছর যদি অন্তত ৮ শতাংশ মতো স্থিতিশীল বিকাশ, আরও বেশি করে কাজের সুযোগ তৈরি করা ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার উপযোগী অর্থনীতি গড়া আমাদের লক্ষ্য হয়, তা হলে স্বাধীনতার ৭১ বছর পরেও আমাদের সেই প্রাথমিক কারণগুলোকেই ফিরে দেখতে হবে।

ওই গেলাসের বাকি অর্ধেকটা সেদিনই সত্যি সত্যিই পূর্ণ হবে যেদিন নতুন ভারত নির্মাণের প্রধান তিন চাবিকাঠি হবে শিক্ষা, গ্রামোন্নয়ন ও শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে উন্নয়নের জোয়ার।

baru_3.jp_081818042552.jpgযা রোপন করেছেন তা তুলেছেন না: কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ দরকার ছিল ৭১ বছর আগেই (ছবি: রয়টার্স)

আকর্ষণীয় একটি তথ্য হল, ভারতরত্নের জন্য প্রথম যে পাঁচজনের নাম করা হয়েচিল তাঁদের মধ্যে একজনমাত্র রাজনীতিক (চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী) ছিলেন। দু’জন নামী শিক্ষাবিদ ছিলেন (সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণন ও ভগবান দাস) এবং ওই তালিকায় একজন বিজ্ঞানীও ছিলেন (চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরমণ)। একথা স্পষ্ট ভাবেই বলা যায় যে আদর্শস্থানীয় ব্যক্তিদের ভারত পেয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতার পরে পরেই।

পরিতাপের কথা হল, আমরা রাষ্ট্রের সেই উচ্চ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাস্তবে আমরা শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে পারিনি। দেশ গড়ার সেই মহান কারিগররা খুব শীঘ্রই বিস্মৃত হলেন, আমরা রাজনীতিক ও বিনোদনকারীদের ভজনা শুরু করে দিলাম।

গত সপ্তাহে একটা খবর দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগল—কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ঠিক করেছেন যে নতুন দিল্লির একটি মেট্রো স্টেশনের নাম দেবেন মহান স্থপতিবিদ (ইঞ্জিনায়ার) এম বিশ্বেশ্বরায়ার নামে। দুঃখের বিষয় হল, সেই সংবাদ প্রতিবেদনে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে কর্নাট,কের মহান সন্তান মোক্ষগুণ্ডম বিশ্বেশ্বরায়া আধুনিক ভারত নির্মাণের একজন কীর্তিমান স্থপতি।

৭১ বছর লেগে গেল দেশের রাজধানী নতুন দিল্লিতে তাঁর নামে কোনও কিছু করতে।

ঘটনা হল, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে দেশের অধিকাংশ পরিকাঠামোমূলক প্রকল্প রূপায়ণ করেছেন বিশ্বেশ্বরায়া, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। তিনি ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ার্সের অন্যতম স্থপতি এবং দেশ গড়ার মহান এক কারিগর।

কথোপকথনের সময় কতজন এমন মহান কীর্তিমান দেশগড়ার কারিগরের কথা আমরা বলে থাকি?

নতুন ভারতে এখন দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরার জন্য রাজনীতিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপকদের (যাঁদের আমরা তথাকথিত ভাবে বিলিয়নেয়ার বলে থাকি) থেকে নজর ঘোরাতে হবে শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, স্থপতিবিদ ও নতুন প্রযুক্তি, পণ্য ও ধারণা তৈরির কারিগরদের দিকে।

আমাদের পূর্বদিকে এশিয়ার যে অংশ হয়েছে তার কথা বিবেচনা করুন। তাদের অনেকের সমাজই উপযুক্ত স্বীকৃতি দিয়েছে শিক্ষক, বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার ও নতুন জ্ঞানের দিশা যাঁরা দেখিয়েছেন তাঁদের। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, সম্পদ ও শক্তিকেন্দ্রিক সমাজ থেকে জ্ঞান-কেন্দ্রিক ভারতের রূপান্তরই হল নতুন ভারত তৈরির প্রাথমিক শর্ত।

baru_4_081818042847.jpg জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা? আজকাল পুস্তক প্রকাশ অনুষ্ঠানে শিক্ষানুরাগী ও লেকখদের বদলে বেশি ডাক পান রাজনীতিকরা (টুইটার)

বই প্রকাশন অনুষ্ঠানে আজকাল প্রায়ই দেখা যায় রাজনীতিকদের। জ্ঞান-নির্ভর সমাজের দিকে এগোনর ক্ষেত্রে এই উলট পুরাণ খুবই বেদনাদায়ক।

জ্ঞানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার পাশাপাশি সেই জ্ঞানের যাঁরা আধার, যাঁরা তার উগ্দাতা, তাঁদের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করতে হবে, ক্ষমতার নিয়ন্ত্রকদের নয়। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে তবেই জ্ঞানের মূল্যায়ন হবে, সামন্ততান্ত্রিকতার সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই শিক্ষক ও জ্ঞানোন্মেষের প্রতিষ্ঠানকে ছাপিয়ে ক্ষমতাশালী হয়েছেন প্রশাসকরা।

baru_5_081818042925.jpg তিনি রয়ে গিয়েছেন জনতার রাষ্ট্রপতি হিসাবে: ব্যতিক্রমী হিসাবে নয়, যাঁদের সত্যিকারের অবদান রয়েছে তাঁদেরই স্মরণ করা উচিত (ইন্ডিয়া টুডে)

ইতিহাসখ্যাত ও সদ্যপ্রাক্তন রাজনৈতিক নেতাদের নামের বদলে যে দিন থেকে ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ও বিভিন্ন স্থানের নামকরণ করা হবে বিশ্বেশ্বরায়া, সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণন, চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরমণ, মেঘনাদ সাহা, বিক্রম সারাভাই, হোমি ভাবা, আব্দুল কালাম এবং ই শ্রীধরণদের নামে সে দিনই ভারতের সেই গেলাস সত্যি সত্যিই পূর্ণতার দিকে আগুয়ান হতে শুরু করবে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SANJAYA BARU SANJAYA BARU @barugaru

Sanjaya Baru is an economist and a writer. He was Media Advisor to Prime Minister Manmohan Singh.

Comment