মেঘালয়ের সেই পবিত্র অরণ্যের অলৌকিক জাদুর সৃষ্টিকর্তা এক ডাকিনী, আমি অন্তত তাই বিশ্বাস করি
মাওফ্ল্যাঙ অরণ্যের জীবনের শিখর কিন্তু অনেক গভীরে, এখনও সেখানে হেঁটে বেড়ায় কিছু অদৃশ্য ছায়া
- Total Shares
এক ডাকিনীর জাদুমন্ত্রে কি একটি পবিত্র অরণ্য সৃষ্টি হতে পারে? একজন ডাকিনী কি কোথাও পার্থিব জাদুর সন্ধান পেয়ে সমস্ত পার্থিব শক্তিকে সেই জায়গায় একত্রিত করতে পারেন?
লোকে বলে ডাকিনীরা নাকি প্রকৃতির শক্তিগুলোর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।তাঁরা নাকি মাটির পদধ্বনি থেকে মাটির তলার জীবনের ধমনীর শব্দও শুনতে পান। তাঁরা নাকি নিজের হাতে বজ্রের স্ফুলিঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং গহন অরণ্যের অলৌকিক জীবরা তাঁদের কথা শুনে চলে।
এই পবিত্র অরণ্য সত্যিই গহন। তবে, ছবির মতো সুন্দরও বটে। এই অরণ্যে হাজার হাজার বছর প্রাচীন গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এই অরণ্যে বলি দেওয়া পাথর দেখতে পাওয়া হয়। প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভও চোখে পড়ে। এছাড়া গর্ত করা গাছের গুড়ি ও শেওলার ঢল তো আছেই। অরণ্যের ইতিউতি রুক্ষ পাহাড় উঁকি মেরে চলেছে এবং অরণ্যেটির মধ্যে দিয়ে একটি জলপ্রাত বয়ে চলেছে যার জল বরফের ন্যায় শীতল। অরণ্যের যত গভীরে আপনি প্রবেশ করবেন ততই গাছের ভিড়ে আকাশের আকার ছোট হতে শুরু করবে। এই অরণ্যের গভীরে দিনের আলো থেকে রাতের অন্ধকারই বেশি চোখে চোখে পড়ে।
এই পবিত্র অরণ্যটির নাম মাওফ্ল্যাঙ। মেঘালয়ের রাজধানী শিলং থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই অরণ্য। পূর্ব খাসি পর্বতমালার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে এই অরণ্য। মেঘালয়কে ঘিরে যত অলৌকিক রহস্য রয়েছে তার সিংহভাগ এই অরণ্যকেই কেন্দ্র করে। খাসিরা মনে করেন যে এই অরণ্যেই তাঁদের দেবদেবীদের পবিত্র মন্দির। আর, তাই এই অরণ্যে যারা প্রবেশ করবে তাঁরা যেন দেবদেবীদের বিরক্ত বা উত্যক্ত না করে এবং এই অরণ্য থেকে কোনও কিছুই যেন বাইরে না নিয়ে যায়।
মেঘালয়ের সেই পবিত্র অরণ্য [ছবি: লেখক]
এই মাওফ্ল্যাঙ অরণ্য আদতে ব্লাহ উপজাতির নিবাস ছিল যারা জয়ন্তী পর্বতের নার অঞ্চল থেকে এখানে এসেছিল। এই উপজাতির সম্প্রদায় এখানে বিস্তার করলেও অচিরেই এখানে একটি জাতি দ্বন্ধের সৃষ্টি হয়। সেই যুদ্ধে জয় হয় হিমা মাওফ্ল্যাঙরা। সেই সময় তারা একজন যোগ্য নেতৃত্ব খোঁজের শুরু করে যে তাদের সমাজের মঙ্গল করতে পারবে।
এর পরেই তারা খা খামাহ নংসাই বলে একজন মহিলার খোঁজ পান। এই মহিলা সাহসী, বুদ্ধিমতী এবং একজন অসাধারণ কূটনীতিক। তিনি কোনও কিছু ঘটার আগেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আঁচ করতে পারতেন। তিনি লিহির সহ্তুনের স্ত্রী এবং স্বামীর সঙ্গে মাওফ্ল্যাঙের সন্নিকটে অবস্থিত লাইতোসহমায় থাকতেন। যদিও তাঁর আদিবাড়ি অসমের বালিগাঁওতে।
এমনিতেই এই উপজাতিরা জাদুবিদ্যা ও ডাকিনী বিদ্যায় বিশ্বাসী। আর, এই মহিলা সেই বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর জাদুবিদ্যার ক্ষমতা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, বলা হত, যে শিলংয়ের সিয়েমরাও তাঁকে ভয় পেত।
মাওফ্ল্যাঙরা যখন তাঁর কাছে যান তিনি তাদেরকে নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, যদি ঈশ্বর অনুমতি দেন তাহলে তিনি তাঁর পুত্রকে তাদের নেতা হিসেবে নিয়োগ করতে পারেন।
কোনও এক ডাকিনীর হাতেই কি সৃষ্ট এই অরণ্যের অলৌকিক ক্ষমতাগুলো [ছবি: লেখক]
ঈশ্বরের ইচ্ছে ঠাওর করতে তিনি ফিফান্দিতে দুটি (মতান্তরে তিনটি) গাছের চারা পোঁতেন। জনশ্রুতি আছে, তিনি বিশ্বাস করতেন যে এই গাছের চারাগুলো যদি তিন বছর জীবিত থাকে তাহলে তাঁর পুত্র মাওফ্ল্যাঙদের নেতৃত্ব দেবেন। এই উপবন তথা এই উপবনের ঈশ্বর তাঁকে এই ভাবেই বার্তা প্রেরণ করবেন।
তিন বছর পরেও গাছের চারাগুলো জীবিত ছিল। তাই তাঁর পুত্র উপজাতির নেতা হলেন এবং তাকে ইউ লিংদোহ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল।
যে পাথরগুলোর উপর তাঁর পুত্রের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল সেগুলো এখনও রয়েছে। লোকের বিশ্বাস সেই পাথরগুলোর পুরোনো শক্তিগুন এখনও একই রকম রয়েছে। কথিত আছে, সেই মহিলা তাঁর পুত্রের নেতা হওয়ার আগে এই পাথরগুলোকে মন্ত্রপূত করে দিয়েছিলেন। অনেকেই আবার বলেন, যে নেতার হওয়ার আগের দিন তিনি পায়ে হেঁটে গোটা অরণ্য ঘুরে মন্ত্রের দ্বারা স্মৃতিস্তম্ভগুলো এবং কিছু গাছের উপরে অদৃশ্য দরজা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন।
এই দরজা গুলো আদতে জানালা হিসেবে কাজ করবে। যেই জানালা দিয়ে এই পবিত্র ভূমির অভিভাবকরা তাঁর পুত্রের উপর নজর রাখতে পারবেন। এই গুপ্ত দরজাগুলোর সম্পর্কে একমাত্র তাঁর পুত্রই অবগত ছিল কারণ প্রয়োজনে তাকে অদৃশ্য দরজাগুলো খুলে অভিভাবকদের এলাকায় প্রবেশ করতে হত।
এখনও অরণ্যের কিছু এলাকা রয়েছে যেখানে অলৌকিক গতিবিধি মালুম করা যায়। পাথর ও গাছগুলোর নিস্তব্ধতার মাঝে অদৃশ্য কিছু ছায়ার চলাফেরা লক্ষ করা যায়। গাছের পাতা, শেওলা কিংবা রাস্তার ধারে এই ছায়াগুলো নড়েচড়ে বেড়ান।
এ অরণ্যের জীবনের শিখর কিন্তু অনেক গভীরে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে