রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড: মৃতদের পরিবারবর্গ কেন দোষীদের মুক্তি চান না?

সম্প্রতি এডিএমকে সরকার সাতজন দোষীj মুক্তির জন্য রাজ্যপালের কাছে সুপারিশ করেছে

 |  4-minute read |   20-09-2018
  • Total Shares

১৯৯১ সালের ২১ মে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছিল। সেদিনের কথা ভুলতে পারেন না ডি ভেদাভল্লি। তাঁর স্বামী জে ধর্মন মণিমঙ্গলম থানার স্পেশাল ব্রাঞ্চের হেড কনস্টেবল ছিলেন। সেদিনের সেই নির্বাচনী প্রচার সভায় তিনিও উপস্থিত ছিলেন।

ঘটনাস্থলের খুব কাছেই থাকেন এই দম্পতি। রাত দশটা নাগাদ তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন সেই নির্বাচনী সভায় হয়ত বাজি ফাটছে। এর পর তিনি বাইরে থেকে একটি শোরগোলের শব্দ শুনতে পান। কিন্তু ঠিক কী ঘটেছিল তা তিনি আঁচ করে উঠতে পারেননি।

body_092018014458.jpg২১ মে, ১৯৯১: শ্রীপেরুমবুদুরে রাজীব গান্ধীর নির্বাচনী সভা। এলটিটিইর মানববোমা ধানু লাল রং দিয়ে চিহ্নিত [সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে]

দুঃসংবাদটা আসে পরের দিন ভোরে। সকাল ছ'টা নাগাদ স্বামীর কয়কেজন সহকর্মী বাড়ি বয়ে এসে স্বামীর মৃত্যুসংবাদটা দিয়ে যান। আর, সেই দিন থেকেই তিন সন্তানের জননী ভেদাভল্লির এক কঠোর পথ চলা শুরু।

মানবিকতার খাতিরে ঘটনার বছর দুয়েক বাদে পুলিশে চাকরি পান ভেদাভল্লি। কিন্তু তাতে অন্ন জুটলেও আর কোনও লাভের লাভ খুব একটা হয়নি। ভেদাভল্লি জানছেন, "আমরা সন্তানরা বাবার ভালোবাসা কোনও দিনও পায়নি। ওদের জীবনে সুপরামর্শ দেওয়ার মতো কেউই ছিল না। আমাদের সাহায্য করতেও কেউই এগিয়ে আসেনি। বাচ্চাদের রীতিমতো কষ্ট করে পালন করতে হয়েছে আমাকে। আর্থিক অভাবে পরিবারকে সাধারণ সুখ স্বাচ্ছন্দ্যও দিতে পারেনি আমি।"

ঘটনার ২৭ বছর পর ভেদাভল্লির জীবনে আবার ওই বেদনাদায়ক দিনটি ফিরে এসেছে। সম্প্রতি, তামিলনাড়ুর এডিএমকে সরকার সেই ঘটনার সঙ্গে যুক্তি সাতজন বন্দির মুক্তির সুপারিশ করেছে। খবরটা শুনে ভেদাভল্লির প্রতিক্রিয়া, "ওরা মুক্তি পেলে ন্যায় বিচার হবে না।"

গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজ্যপাল বনোয়ারিলাল পুরোহিতের কাছে তামিলনাড়ুর মন্ত্রিসভার তরফ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে যাতে রাজীব গান্ধীর হত্যার সঙ্গে যুক্ত যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সাতজন আসামিকে সংবিধানের ১৬১ ধারা প্রয়োগ করে মুক্তি দেওয়া হয়। এই ঘটনায় রাজীব গান্ধী ছাড়াও আরও ১৩জনের মৃত্যু হয়েছিল। সরকারের এই পদক্ষেপে স্বভাবতই যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়েছেন ওই ১৩জনের পরিবারবর্গ।

body1_092018014728.jpgরাজীব গান্ধী হত্যা কাণ্ডে যাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল [সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে]

ভেদাভল্লি ছাড়াও আরও অনেকে রয়েছেন যাঁরা সরকারের এই সিদ্ধান্তে নিজেদের বঞ্চিত বলে মনে করছেন।

যেমন এস আব্বাস। মাত্র আট বছর বয়সে ওই ঘটনায় আব্বাসের মা এস সমধানি বেগম নিহত হন। সেদিন তার দাদা তাঁদের বিধবা মাকে ওই অনুষ্ঠানে যেতে বারংবার নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু গান্ধী পরিবারের অন্ধভক্ত তাঁদের মা সেই নিষেধে কান দেননি।

দক্ষিণ চেন্নাই মহিলা কংগ্রেসের জেলা সভাপতি হিসেবে সেদিন বেগম রাজীব গান্ধীকে শাল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। দুর্ঘটনার সময়ে তিনি রাজীব গান্ধীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এর পর বেগমের ক্ষতবিক্ষত দেহ যখন কম্বলে জড়ানো অবস্থায় তাঁর বাড়িতে পৌঁছায় তখন স্পষ্টতই ভেঙে পড়ে তাঁর পরিবার। বেগমের সাত সন্তান খুব অল্প বয়েসেই অনাথ হয়ে যায়।

দোষীদের মানবিকতার কারণে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষিপ্ত আব্বাস, "এর আগে ফাঁসির সাজাকে কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হল। খুনিদের এর চাইতে বেশি আর কী মানবিকতা দেখানো যেতে পারে? আমাদের দুঃখ দুর্দশার কি কোনও দাম নেই? ওদের তো আগেই ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।"

আব্বাসের দাবি, এই ঘটনায় নিহতদের অনেকেই ক্ষতিপূরণ হিসেবে চাকরি বা এলপিজি গ্যাসের ডিস্ট্রিবিউটরশিপ পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে।

নিহতদের পরিবারের সদস্যরা রাজ্যপাল পুরোহিতকে চিঠি লিখে তাঁর সঙ্গে দেখা করার আর্জি জানিয়েছেন এবং রাজ্যপালকে অনুরোধ করেছেন তিনি যেন বন্দিদের মুক্তির জন্য সম্মতি না দেন। অনেকেই মনে করছেন এই বন্দিদের মুক্তি বিপজ্জনক নজির হিসেবে গণ্য হবে এবং তা জাতীয়স্বার্থবিরোধী হবে।

body2_092018015110.jpgপ্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আর বেঙ্কটরমণ নিহতদের একজনের পরিবারকে এলপিজি ডিস্ট্রিবিউটরের লাইসেন্স পেতে সাহায্য করেছিলেন [ছবি: পিটিআই]

ওই দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন তামিলনাড়ুর বিধান পরিষদের প্রাক্তন সদস্য লিগ মুনুস্বামী। তাঁর পুত্র লিগ মোহন জানাচ্ছেন, "রাজীব গান্ধী ছাড়াও ওই ঘটনায় আরও ১৩জন নিহত হয়েছিলেন। গান্ধী পরিবারের সদস্যরা হয়তো দোষীদের ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু তা হলেও আমাদের মতামতেরও একটা দাম রয়েছে।"

স্বাধীনতা সংগ্রামী মুনুস্বামী সেদিন সভার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। বিস্ফোরণের সময়ে তিনি একেবারে প্রথম সারিতে বসে ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬৪ বছর। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আর বেঙ্কটরামনের অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিলেন মুন্নাস্বামী। আর বেঙ্কটরমণ সুপারিশে মুন্নাস্বামীর পরিবার এলপিজি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউটরের লাইসেন্স পেয়েছিল। মোহনের দাবি, কংগ্রেস দল তাঁর বাবার আত্মত্যাগের কথা মনে রাখেনি।

ওই ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর এডওয়ার্ড জোসেফ। সেদিন রাজীব গান্ধীর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন এডওয়ার্ড। দাদার ছবি ঘাটতে ঘাঁটতে তাঁর ভাই জন জানালেন, "মৃতের পরিবারবর্গ অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কিন্তু প্রশাসনের তরফ থেকে কখনও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রশাসন আমাদের দুঃখ-দুর্দশা বেদনাকে পাত্তাই দেয় না। আমার বৌদি সরকারি সাহায্যের আশায় প্রচুর লোকের কাছে দরবার করেছিলেন। সমস্ত চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পরে এখন তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন।"

body3_092018015253.jpgশুধু রাজীব গান্ধী নয়, ওই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল আরও ১৩জনের [ছবি:পিটিআই]

মাত্র ৩৯ বছর বয়সে নিহত হয়েছিলেন এডওয়ার্ড। তিনি সিআইডির স্পেশাল ব্রাঞ্চে কর্মরত ছিলেন এবং এক সময় তিনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এমজি রামচন্দ্রণের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আধিকারিক ছিলেন। পুলিশকর্মী হিসাবে এডওয়ার্ডের জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো এবং তাঁর কাজের জন্য তিনি বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষিকা স্ত্রী ও দুই কন্যা রয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর সময়ে কন্যাদের বয়স ছিল নয় বছর ও সাত বছর।

প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক অনসূয়া ডেইসি অ্যার্নেস্ট ঘটনার দিন বরাত জোরে রক্ষা পেয়েছিলেন। বিস্ফোরণের আগে ডেইসি রাজীব গান্ধীর হত্যাকারী ধানুকে আটকাবার চেষ্টা করেছিলেন। ঘটনার ২৭ বছর বাদে সরকারি সিদ্ধান্তে তিনিও ভেঙে পড়েছেন।

সেদিনের ঘটনায় মারাত্মক জখম হয়েছিলেন অনসূয়া। বেশ কয়েকবার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল তাঁকে। অনুসূয়া জানাচ্ছেন, "প্রায় মাস তিনেক হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম আমি। বাঁহাতের দুটি আঙ্গুল কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। সেদিন তামিলনাড়ুতে রীতিমতো সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল জঙ্গিরা। ওই জঙ্গিদের ক্ষমা করার কোনও কারণ থাকতে পারে না।"

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

LOKPRIA VASUDEVAN LOKPRIA VASUDEVAN @lokpria

Principal Correspondent with India Today TV.

Comment