আগে কী নামে সম্প্রচারিত হত প্রভাতী মহিষাসুরমর্দিনী?

অনুষ্ঠানের ভাবনা কেমন করে এসেছিল প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মাথায়?

 |  6-minute read |   08-10-2018
  • Total Shares

মহালয়ার ভোরে আজ যদি আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটি প্রচারিত না হত তবে বাঙালি, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, মনে ভাবতেই পারবেন না বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ উৎসব ঘরের দরজায়।

ইন্টারনেটের  যুগেও এই একটা দিন বেতারের প্রভাতী অনুষ্ঠান মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচারিত হওয়ামাত্র আকাশে বাতাসে পুজোর গন্ধ ছড়িয়ে যায়। তার অনেক আগেই যদিও বা পুজোর আয়োজন শুরু  হয়ে যায়; বিশেষত থিমের পুজো এবং হাজারো বিজ্ঞাপনের সৌজন্যে। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে আজও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পাঠ, ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু...’ প্রভৃতি গানের সুরেই ইট-কাঠ-কংক্রিটের বসতিতে শিশির ভেজা শিঊলির গন্ধ ভেসে আসে। বহুতলের ভিড়ে ঢেকে যাওয়া আকাশে সাদা তুলো মেঘ উড়তে দেখা যায়, এক ফালি জমির বুকে জেগে ওঠে কাশ ফুলের গুচ্ছ। শত আয়োজনের মাঝেও এগুলিই যে শারদ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ তা জানান দেয় বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক প্রমুখের মহিষাসুরমর্দিনী। বিগত আট দশকেরও বেশি সময় ধরে বাঙালি জীবনে এমনটাই হয়ে আসছে।

birendra-bhadra_100818014930.jpg(বাঁদিক থেকে) বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

কাতা বেতার কেন্দ্র

১৯২৭ সালে ডালহৌসির গাস্টির্ন প্লেসে বোম্বের ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি একটি বেতারকেন্দ্র স্থাপন করে। ভারতীয় ও ইউরোপিয়ান- দু’ ভাগে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করা হয়।

ভারতীয় প্রোগ্রামের ডিরেক্টর হিসেবে প্রথম দিন থেকেই দায়িত্ব নেন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। কিছুদিনের মধ্যেই ফেয়ারলি প্লেসের ইস্টার্ন রেলের চাকরি ছেড়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও  টাঁকশালের চাকরি ছেড়ে রেডিয়োতে আসেন বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য বা বাণীকুমার। যোগ দিলেন রাইচাঁদ বড়াল, হীরেন বসুও। আগেই ঘোষক ও সংবাদ-পাঠক হিসেবে এসেছিলেন মোহনবাগানের ১৯১১ সালের ঐতিহাসিক শিল্ডজয়ী দলের হাফব্যাক রাজেন সেনগুন্ত। কোনও দিন চাকরি না করলেও বেতারের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। বাঙালি জীবনে জুড়ে গেল বেতার।  

আশ্বিনের শারদপ্রাতে

বেতারকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হবে একটি নিজস্ব মুখপত্র, সম্পাদনার জন্য এলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। প্রথম ‘বেতার জগৎ’ প্রকাশিত হল ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী বললেন, যা যা অনুষ্ঠান চলছে, তার পাশাপাশি কিছু অভিনবত্ব আনাও দরকার। এক আড্ডার আসরে বললেন, “এই তো বাণী রয়েছে; ওই কতকগুলো বৈদিক শ্লোক জোগাড় করে ফেলুক, আর গান লিখুক।  রাই (রাইচাঁদ বড়াল ) সুর দিক, বীরেন শ্লোক আওড়াক, ভোরবেলায় লোকের ভালো লাগবে।”

birendra_embed_100818015041.jpgদুর্গাপুজোর আমেজটাই আসে না বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠ ছাড়া

কথাটা নৃপেন মজুমদারের মনে ধরল। এসব কথা যখন হচ্ছে,  তার একমাস বাদে দুর্গাপুজো। বাণীকুমার ভাবতে বসে গেলেন। বীরেন ভদ্র প্রস্তাব দিলেন, যদি পুজোকে কেন্দ্র করেই কিছু করা হয় তাতে চণ্ডীপাঠ অবশ্যই থাকবে। কিন্তু, একটা ব্যাপারে যেন দ্বিধা থাকছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তো কায়স্থ, তিনি চণ্ডীপাঠ করলে সবাই মেনে নেবেন তো? সেই সময় এই দ্বিধাগ্রস্ততা অস্বাভাবিক নয়। তবে নৃপেনবাবু বলেছিলেন, “করবে একটা প্রোগ্রাম, তার আবার বামুন কায়েত কি? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবে তারা তো অর্ধেক মুসলমান, খুশী মহম্মদ, আলী, মুন্সী সবাই তো বাজাবে, তা হলে তাদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়।” অনুষ্ঠানের রিহার্সাল চলাকালীন বীরেন ভদ্র যখন বাংলা ও সংস্কৃত স্তোত্র পাঠ করছিলেন, তার ভাষাগত তফাত করতে পারছিলেন না, যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীদের দলে থাকা অধিকাংশ অবাঙালি মুসলিম বাজিয়ের দল। ফলে তাঁরা সব জায়গায় বাজাচ্ছিলেন। বীরেনবাবু কিন্তু তাঁদের থামালেন না। বাংলার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষ্যকেও সুর বলে বাজনার সুরের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। এক অন্য রূপ পেল স্তোত্রপাঠ। যা আমরা আজও শুনি। উস্তাদি যন্ত্রসঙ্গীতের সুরের সঙ্গে মিলে গেল চণ্ডীপাঠের সুর। তৈরি হল এক অপূর্ব ধর্মীয় বিনিময়।

প্রভাতী আনুষ্ঠানের নানা কথা

১৯৩২ সালে দুর্গাপুজোর মহাষষ্ঠীর সকালে ‘প্রত্যুষ প্রোগ্রাম’ শিরোনামে প্রথম সম্প্রচারিত হয় ওই অনুষ্ঠান। পরের বছরও সম্প্রচারিত হয় ওই অনুষ্ঠান; নাম দেওয়া হয় ‘প্রভাতী অনুষ্ঠান’। অনুষ্ঠানটি ১৯৩৪ সালের ৮ অক্টোবর প্রথমবার মহালয়ার সকালে সম্প্রচার করা হয়। এরপর ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটির নাম হয়  ‘মহিষাসুর বধ’। ১৯৩৭ সালে এই অনুষ্ঠানের নামকরণ স্থায়ী ভাবে হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ যা ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে মহাষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচারিত হয়ে কিছু অদলবদল হয়ে অবশেষে মহালয়ার ভোরেই সম্প্রচার স্থায়ী হয়। বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রমুখের লেখা থেকে জানা যায় অনুষ্ঠানের আগের দিন রাত্রে স্টুডিয়োতেই থাকতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। অন্য শিল্পীদের রাত দু’টো নাগাদ স্টুডিয়োয় নিয়ে আসা হত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ স্টুডিওতেই স্নান সেরে গরদের ধুতি ও চাদর পরতেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে শাঁখ বেজে উঠত। শুরু হত লাইভ প্রোগ্রাম।

অনুষ্ঠানে নানা বদল

প্রথম দিকে কয়েক বছর রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক যুগ্ম সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। তবে অধিকাংশ গান পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপিত।  কিন্তু ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে…’  পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী, ‘শান্তি দিলে ভরি…’  উস্তাদ সাগির খাঁ এবং ‘নিখিল আজি সকল ভোলে …’ গানে  সুর করেন রাইচাঁদ বড়াল প্রমুখ। প্রসঙ্গত,  ‘নিখিল আজি…’ গানটি বাদ পড়ে বহু আগেই। এ রকম অনেক গান ছিল যা পরে মহিষাসুরমর্দিনী থেকে বাদ পড়ে। একটি দুটি গান বিকল্প বা পরিবর্তীত হিসেবেও ভাষ্যে উল্লেখ করেছেন বাণীকুমার, যে গান বহু বছর আগে থেকেই শোনা যায় না। সংস্কৃত স্তোত্রও অনেক বাদ গিয়েছে।

সময়ের কথা মাথায় রেখেই এগুলো করতে হয়েছে।  প্রথম দিকে এক ঘণ্টা, কোনও কোনও বছর দু’ঘণ্টা – পরবর্তীতে অনুষ্ঠানটি মোটামুটি দেড় ঘণ্টায় স্থায়ী হয়। মোটকথা ১৯৭২ সালে স্থায়ী ভাবে রেকর্ড হওয়ার আগে পর্যন্ত  এই অনুষ্ঠানের অজস্র পরিবর্তন ঘটেছে।

উল্লেখ্য, সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে বেতার কর্তৃপক্ষের কোনও কারণে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯৪৪ ও ১৯৪৫ বছর দু’টিতে তাঁর জায়গায় প্রথমবার গানের সুর এক রেখে গোটা অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত পরিচালনার কাজ সামলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৫ সালে অন্য গানসহ সম্পূর্ণ নতুন একটি অনুষ্ঠান যেটি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নয় সম্প্রচারিত হয়। যাতে যৌথ সঙ্গীতপরিচালক ছিলেন বিজনবালা ঘোষদস্তিদার ও শচীন দাশ মতিলাল। কিন্তু সেটি শ্রোতাদের একেবারেই পছন্দ হয় না। অবশেষে ১৯৪৬ সালে একইসঙ্গে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ ও পঙ্কজকুমার মল্লিক-এর  প্রত্যাবর্তন ঘটে। সে বছর অবশ্য লাইভ না হয়ে রেকর্ডেড সম্প্রচার করতে হয়। কারণ সে বছর ১৬ অগস্ট থেকে কলকাতায় যে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়েছিল তাতে অত রাতে শিল্পীদের আনার ঝুঁকি কর্তৃপক্ষ নেননি।

১৯৩২ সাল ১৯৬২ অবধি থেকে লাইভ সম্প্রচার-ই হত।  কেবল রেকর্ডারের অনুন্নত মানের জন্য ২-৩ বছর অন্তর নতুন করে রিহার্সাল দিয়ে রেকর্ডিং করতে হত। স্থায়ী রেকর্ডিং হয় ১৯৭২ সালে।  অনুষ্ঠানের আদিযুগে গাইতেন কৃষ্ণ ঘোষ, আভাবতী, প্রফুল্লবালা, বীণাপানি, প্রভাবতী প্রমুখ। পঙ্কজ মল্লিক ছাড়া এঁদের কারওরই কণ্ঠ পরে আর শোনা যায়নি।  

‘বেতার জগৎ’ পত্রিকা থেকে জানা যায়, ১৯৪০-এ গাইতেন পঙ্কজ মল্লিক, অনিল দাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শৈলদেবী, ইলা ঘোষ, সুপ্রভা ঘোষ (সরকার), কল্পনা হাজরা প্রমুখ। অর্থাৎ ১৯৭২ সালে স্থায়ী রেকর্ডিংয়ের আগে পর্যন্ত বহুবার শিল্পী পরিবর্তন ঘটেছে। এমনকী এই অনুষ্ঠানে গেয়েছেন জগন্ময় মিত্র, রাধারানী দেবী, সাবিত্রী ঘোষ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, শচীন গুন্ত, বাঁশরী লাহিড়ি, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, কল্যাণী মজুমদার, অখিলবন্ধু ঘোষ প্রমুখ। এঁদের গানও পরবর্তীতে আর  যায়৷ শোনা যায় নি। জানা যায়, শৈল দেবী গাইতেন, ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে…’, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু…’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯৪০ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানে গাইতেন, ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী…’ ছাড়াও অন্য গান, গলা মেলাতেন কোরাসে এবং সঙ্গীত পরিচালনাতেও সাহায্য করতেন।

uttam_100818015234.jpgমহানায়ক হিসাবে বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে নিলেও উত্তমকুমারকে বাঙালি মহালয়ার সকালে মেনে নেয়নি

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, ‘তব অচিন্ত্য …’ গানটিও প্রথম দিকে ছিল না। অন্যদিকে  কৃষ্ণচন্দ্র দে, যূথিকা রায়, শচীন দেব বর্মন, কানন দেবী, কে এল সায়গল, সুধীরলাল চক্রবর্তী, রবীন মজুমদার, মান্না দে’র মতো বিখ্যাত শিল্পীরা কোনও দিনই এই অনুষ্ঠানে গান করেননি। নানা সময়ে এই অনুষ্ঠানে এসেছিল বেশ কিছু পরিবর্তন। বদলেছিল শিল্পীর তালিকাও। শুধু বদলায়নি গ্রন্থণা ও শ্লোক আবৃত্তির শিল্পী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

মহানায়কও পরাস্ত

১৯৭৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, মহালয়ার ভোরবেলা আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে বেজে উঠল  চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র বদলে ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্‌’৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আশ্বিনের শারদ প্রাতের বদলে মহানায়ক উত্তমকুমার বসন্ত চৌধুরী, পার্থ ঘোষ, ছন্দা সেন, মাধুরী মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য,  প্রমুখের ভাষ্যপাঠ।

‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সেই এক মহালয়াতেই বাতিল হয়েছিল। এসেছিল ওই নতুন অনুষ্ঠান৷ যার প্রধান ভাষ্যপাঠক ছিলেন উত্তমকুমার। বাণীকুমারের আলেখ্যর পরিবর্তে ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তীর স্ক্রিপ্ট। গান লিখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গান গেয়েছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী সেনগুপ্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অসীমা ভট্টাচার্য, অনুপ ঘোষাল, অপর্ণা সেনগুপ্ত, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলে।

প্রথম বারের জন্য সেই ঐতিহ্য ছিন্ন হল কিন্তু শ্রোতাদের প্রবল আপত্তিতে কর্তৃপক্ষ ফের মহিষাসুরমর্দিনী বাজাতে বাধ্য হন।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

TAPAN MALLICK CHOWDHURY TAPAN MALLICK CHOWDHURY

The writer is a journalist.

Comment