অটল বিহারী বাজপেয়ী - দল মত নির্বিশেষে তিনি দেশের অন্যতম প্রিয় নেতা ছিলেন

ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে তিনিই সবচেয়ে জনপ্রিয়

 |  4-minute read |   17-08-2018
  • Total Shares

গোটা বিশ্বই অটল বিহারী বাজপেয়ীকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনে রাখবে। রাজনৈতিক দল মত নির্বিশেষে তিনি সকলেরই প্রিয় পাত্র হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। এটাই ছিল অটল বিহারী বাজপেয়ীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট। একটা কথায় নিঃসন্দেহে বলে ফেলা যায় যে ভারতের চারজন শ্রেষ্ট প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় জওহর লাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, নরসিমহা রাওর সঙ্গে তাঁর নামটিও জ্বলজ্বল করবে। এনারা প্রত্যেকেই দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিদেশেও ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিভাজনটা বেশ স্পষ্ঠ। যাঁরা নেহরু বা ইন্দিরার ভক্ত তাঁরা কোনও ভাবেই নরসিমহা রাও বা মনমোহন সিংকে মেনে নিতে চান না। আবার মোদী ভক্তরা নেহরু বা ইন্দিরাকে মেনে নিতে পারেন না।

কিন্তু অটল বিহারী বাজপেয়ির ব্যাপারটা এদের থেকে একেবারেই আলাদা। আগেই বলেছি দল মত নির্বিশেষে তিনি সকলেরই প্রিয় পাত্র ছিলেন।

body_081718051055.jpgপ্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী [ছবি: পিটিআই]

খুব সম্ভবত ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে তিনিই সবচেয়ে জনপ্রিয়। পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা বা ভারত-শ্রীলঙ্কার মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি তাঁর আমলেই হয়েছিল।

এখন প্রশ্নটা হচ্ছে বাজপেয়ীর এই জনপ্রিয়তার পিছনে আসল রহস্যটা কী?

প্রথমত, তিনি ছিলেন উদার মনোভাবাপন্ন। তিনি সকলকেই শ্রদ্ধা করতেন এবং তাই সকলেই তাঁকেও শ্রদ্ধা করত। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে খোদ জওহর লাল নেহরু তাঁকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যখন পাকিস্তান সফরে গেলেন তখন তিনি মিনার-ই-পাকিস্তান গিয়ে পাকিস্তানের নাগরিকদের অবাক করে দিয়েছিলেন।

body1_081718051210.jpgনওয়াজ শরিফের সঙ্গে ছিল অটুট বন্ধুত্ব [ছবি: রয়টার্স]

দ্বিতীয়ত, বাজপেয়ী দেশাত্মবোধ ছিল প্রশ্নাতীত। তাই তো জাতীয় স্বার্থে তিনি বরাবরই আম ভারতবাসীর প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে পেরে ছিলেন। ১৯৯৪ তৎকালীন বিদেশ প্রতিমন্ত্রী সালমান খুরশিদের সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনে গিয়েছিলেন কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের হয়ে সওয়াল করতে। সেই সময় তিনি সংসদের বিরোধী দলনেতা। ১৯৯৮ সালে তীব্র আন্তর্জাতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর আমলেই ভারতে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করা হয়েছিল। দলের মধ্যে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তিনি 'নো ফার্স্ট ইউজ' নীতির পক্ষে সায় দিয়েছিলেন। এই নীতি অনুযায়ী শত্রুপক্ষ প্রথমে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করলে ভারত পাল্টা ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু ভারত কখনই প্রথমে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না।

body5_081718051800.jpgপিডিপি নেতা মুফতি মহম্মদ সৈয়দের সঙ্গে [ছবি; পিটিআই]

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাজপেয়ী খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারতেন যে দেশের জন্যে কোন কোন নীতিগুলো কার্যকরী হবে। এবং তিনি এই প্রকল্পগুলোকে রূপায়ণের জন্যে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এর মধ্যে অনেকগুলো অর্থনৈতিক বা জাতীয় সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রকল্প নরসিমহা রাওয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত। বিজেপি যতই নরসিমহা রাওয়ের অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলোর বিরোধিতা করুক না কেন, বাজপেয়ী বুঝেছিলেন প্রকল্পগুলো দেশের জন্যে কতটা কার্যকরী হতে পারে। আর, দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও সেই প্রকলগুলো রূপায়নের কোনও কসুর করেননি।

body2_081718051327.jpgদল মত নির্বিশেষে বাজপেয়ী জনপ্ৰিয় ছিলেন [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]

অনেকেই মনে করেন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে এই পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের দীর্ঘকালীন অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে তাঁর রূপায়ণ করা প্রকল্পগুলো অনেক বেশি কার্যকর। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই ও কলকাতাকে সড়ক পথে যোগ করবার জন্য সোনালী চতুর্ভূজ প্রকল্প তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন। জওহার লাল নেহরুর সেচ প্রকল্পগুলোর পরে এই প্রকল্পটিকে দেশের পরিকাঠামো উন্নয়নের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হিসেবে মনে করা হয়। বাজপেয়ীর আমলে যে ভাবে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে তথ্যপ্রযুক্তিরও প্রসার ঘটে।

কার্গিল যুদ্ধের সময় বাজপেয়ীর কঠোর সিদ্ধান্তগুলো আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের সম্মান অনেকটাই বাড়িয়ে ছিল। শুধুমাত্র হিমালয়ের পাহাড়গুলোতে নয় কূটনৈতিক ঘরেও কার্গিল যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল ভারত। এই যুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এলওসিকে ভারত পাকিস্তানের সীমান্তরেখা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন শেষ দু'বছরে বাজপেয়ী এমন দুটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন যা তাঁর উত্তরসূরির আমলের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য প্ৰকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তিনি যেভাবে পাকিস্তানের কাছে এবং ২০০৩ সালে কাশ্মীরের জনতার কাছে পৌছিয়ে গিয়েছিলেন তা থেকেই ভবিষ্যতে মনমোহন ও পারভেজ মুশারফের বৈঠক সম্ভবপর হয়েছিল। যে ভাবে একজন বিজেপি নেতা প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে ভেবেছিলেন তা তাঁর কংগ্রেসি উত্তরসূরির কাজটা অনেকটাই সহজ করে দিয়েছিল।

body3_081718051438.jpgপোখরানে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে [ছবি: রয়টার্স]

মনমোহন সিংয়ের আমলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে অসামরিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর হয়। কিন্তু এই চুক্তির সূত্রপাত কিন্তু বাজপেয়ীর হাত ধরেই। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের 'স্বাভাবিক বন্ধু' হিসেবে সম্বোধন করার পরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানিয়েছিলেন যে দুই দেশের মিত্রতা আদতে 'একুশ শতকের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বন্ধুত্ব'। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টায় বাজপেয়ীর দেখানোর পথেই মনমোহন সিং পরবর্তীকালে হেঁটেছেন।

body4_081718051649.jpgকার্গিলে বাজপেয়ী, জর্জ ফার্নান্দেজ ও ফারুক আব্দুল্লাহ [ছবি: টুইটার]

পরিশেষে একটি কথা বলতেই হচ্ছে। বিশ্লেষকরা হয়ত বাজপেয়ীর প্রকলগুলো নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন, কিন্তু ভারতীয় মাত্রেই বাজপেয়ীকে একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে মনে রাখবেন। তাঁর বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন ও তাঁর নিজের লেখা কবিতাগুলোর জন্যে তিনি সমাদৃত হয়ে থাকবেন।সাম্প্রতিক অতীতে আর কোনও রাজনৈতিক নেতা গোটা দেশে সকলের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠতে পারেননি। সত্যিই রীতিমতন অসাধ্য সাধন করেছেন অটল বিহারী বাজপেয়ী।

লেকটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SANJAYA BARU SANJAYA BARU @barugaru

Sanjaya Baru is an economist and a writer. He was Media Advisor to Prime Minister Manmohan Singh.

Comment