দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের ফল ২০১৯ সালের আগে জনতার বিজেপি-ঘেঁষা মনোভাবের প্রতিফলন
চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই জিতেছে এবিভিপি
- Total Shares
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ (ডিইউএসইউ) নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছে, তাতে চারটি পদের মধ্যে তিনটিতেই জয়ী হয়েছে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ বা এবিভিপি।
যা মনে করা হয়েছিল সেই মতোই ফল প্রকাশের পরে ফের দোষারোপ করা শুরু হয়েছে ইভিএমকে। বেশ কিছুদিন ধরে এটাই চলছে – পুর নির্বাচন হোক, বিধানসভা নির্বাচন হোক বা কোনও ছাত্র সংসদের নির্বাচন হোক, যারা হেরে যায় তারা অন্যায় হয়েছে বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দেয়, দোষ দেয় বেচারি ইভিএমের উপরে যার আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও উপায়ই নেই।
গেরুয়ায় ঝোঁক: দিল্লি বিশ্বিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সভাপতি, সহ-সভাপতি ও যুগ্ম সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছে এবিভিপি। সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছে এনএসইউআই (ছবি: এএনআই)
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের সবচেয়ে সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে প্রতি বছর বিভিন্ন পাঠ্যক্রমে কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনও রকম বৈষম্য কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ আর এখানে ভর্তির জন্য সারা পৃথিবী থেকে আবেদন জমা পড়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা থেকে ছাত্রছাত্রীরা এসে একসঙ্গে পঠনপাঠন করে বলে ছাত্রছাত্রীদের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও মিলমিশ লক্ষ্য করা যায়।
দু-সপ্তাহব্যাপী ঘোরতর নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সঙ্গেই মোটামুটি ৬৩টি বিভিন্ন কলেজে একই পদ্ধতিতে ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়। অন্তত এক লক্ষ ছাত্রছাত্রী এই প্রথম বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র বা ইভিএম ব্যবহার করার সুযোগ পায়।
এই পদ্ধতি থেকে তারা গণতন্ত্রিক পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে পারে, গণতন্ত্র সম্বন্ধে তাদের মনে ধারনা তৈরি হয়।
এ বছর মোট ভোট পড়েছে ৪৪.৪৬% যা গতবারের চেয়ে মোটামুটি ২% বেশি। ভোটের হার যে বাড়ছে তা শুভ লক্ষণ, এর অর্থ হল নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহী হচ্ছে।
এভিবিপি এবং ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া (এনএসইউআই) এবং অন্য চাত্র সংগঠনগুলোর মূল রাজনৈতিক সংগঠন দাবি করে যে তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনে যোগ নেই, তবে বাস্তবে দেখা যায় যে বিজেপি, কংগ্রেস ও অন্য রাজনৈতিক দলের বরিষ্ঠ নেতারা তাদের অনুমোদন করা ছাত্রসংগঠনগুলিকে সব ধরনের সহায়তা করে থাকে।
ঘটনা হল এবিভিপি এবং এনএসইউআই কোনও আইনি দ্বন্দ্বে জড়ালে তাদের হয়ে মামলা লড়েন যথাক্রমে আরএসএস এবং কংগ্রেসের ওজনদার কৌঁসুলিরা, যা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় চাত্র সংসদ তাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগের বছর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ভোটের হার বেড়েছে, এতেই বোঝা যাচ্ছে যে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রাজনৈতিক আগ্রহ বাড়ছে। (ছবি: পিটিআই)
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রার্থীরা ঝাণ্ডেওয়ালান অফিস (আরএসএস) এবং ১০ জনপথে (কংগ্রেস) তাদের রাজনৈতিক/ আদর্শগত নেতাদের নেতানেত্রীদের আশীর্বাদ নিতে যাওয়ার ছবি আপনারা সংবাদপত্রে দেখে নিতে পারেন।
প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলকেই বরিষ্ঠ নেতা দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় তা সে বিজেপি হোক, কংগ্রেস বা আপ। অরুণ জেটলি, বিজয় গোয়েল এবং অজয় মাকেন থেকে নতুন মুখ অলকা লাম্বা, তরুণ কুমার, সুস্মিতা দেব, অনিল চৌধরী, অনিল ঝা এবং অরবিন্দর সিং লাভলি – সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া থাকাকালীন ভীষণ ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বস্তত, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন হল দেশের মতামতের নির্দেশক।
বিশাল স্যাম্পেল সাইজ – তা সংখ্যার বিচারেই হোক বা বৈচিত্র্যের বিচারে – থেকে রাজনৈতিক পণ্ডিতরা রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচন ও লোকসভা নির্বাচনের প্রাক নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ শুরু করে দেন এই ফলাফল দেখেই।
একটা ব্যাপার নজর করা যেতে পারে। আমরা যদি লোকসভা নির্বাচনের আগে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটের শতাংশের হিসাব গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করি আমরা দেখব যে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে এনএসইউআই জয়ী হয়েছিল এবং কেন্দ্রে সরকার গড়েছিল কংগ্রেস।
একই ভাবে ২০০৮ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি আসনের তিনটিতে জয়ী হয়েছিল এনএসইউআই এবং ২০০৯ সালে কংগ্রেস ক্ষমতা ধরে রেখেছিল। ২০১০ সালের পর থেকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদে এবিভিপির ভোটের হার বাড়তে শরু করে এবং ২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভাবে জয়ী হয় বিজেপি।
অবশ্যই এই ঘটনাক্রম কাকতালীয়ও হতে পারে – তবে পরিসংখ্যানবিদরা কি এই পদ্ধতিতেই গবেষণা করেন না? সংখ্যা কখনও মিথ্যা বলে না, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ও সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্বন্ধ তো রয়েইছে।
একটি আকর্ষণীয় তথ্য হল, সাধারণ নির্বাচনের আগে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোটের হার বেড়ে যায়, যা থেকে বোঝা যায় যে ছাত্রছাত্রীরা নির্বাচনের আগে রাজনীতি নিয়ে তপর হয়ে ওঠে।
২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মোট প্রদত্ত ভোট ছিল ৬৬.৪% (সর্বকালীন রেকর্ড), দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভোটেও প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৪৪.৪% যা রেকর্ডের কাছাকাছি।
২০১৩ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র পরিষদের ভোটে জয়ী হয়েছিল এবিভিপি এবং পরের বছর ভোটে বিপুল ভাবে জয়ী হয় বিজেপি (ছবি: পিটিআই/ফাইল)
এ বছর দেখা গেল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে ৪৪.৬% শতাংশ ভোট পড়েছে এবং চারটির মধ্যে তিনটি আসনে জয়ী হয়েছে এবিভিপি। এই ফল থেকে বোঝা যাচ্ছে যে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক শাখা দেশের তরুণদের মনের কথা অন্য রাজনৈতিক সংগঠনের তুলনায় অনেক বেশি করে বুঝতে পেরেছে।
২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন আর খুব দূরে নেই – দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ফল কংগ্রেসের কাছে খুব একটা আশাব্যঞ্জক বার্তা বয়ে আনছে না।
গত বছর যখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনে কংগ্রেস দুটি আসনে জয়ী হয়েছিল, তখন বিন্দুমাত্র দেরি না করে কংগ্রেস বলেছিল যে, তরুণরা প্রধানমন্ত্রী মোদীর উপর থেকে আস্থা হারিয়েছে, এখন তারা রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বের অপেক্ষায় দিন গুনছে।
এখন কংগ্রেস কী বলবে?
গত বছর এবিভিপি ও বিজেপি চেষ্টা করছিল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ফলে গুরুত্ব না দিতে। এবার কংগ্রেস যে সেই কাজই করবে সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই – ঘটনা হল তারা ইতিমধ্যেই ইভিএম-কে দোষ দিতে শুরু করে দিয়েছে।
তবে এই নির্বাচনের এবং পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলির যে পরিসংখ্যান আমরা দেখছি তাতে ২০১৯ সালের নির্বাচনের জন্য বেশ কয়েকটি সূত্র আমরা পেয়ে যাচ্ছি।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে