মূল ভাড়া নির্দিষ্ট হলেও, প্রতি ক্ষেত্রেই অ্যাপ ক্যাবগুলোর সারচার্জ ধার্য করার প্রবণতা বাড়বে
চাহিদা বাড়লে সারচার্জ বাড়ে, কিন্তু পরিস্থিতি হিসেব করার কোনও মাপকাঠি এখনও নেই
- Total Shares
কলকাতার অ্যাপ ট্যাক্সিগুলোর ভাড়া নির্ধায়ক ভিত্তিটা ঠিক কী?
কখনও উপভোক্তা বা যাত্রী হিসেবে আবার কখনও সাংবাদিক হিসেবে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বৃথা চেষ্টা করেছিলাম। উত্তর মেলেনি।
প্রতিবারই, অ্যাপ ক্যাব সংস্থাগুলো তাদের সরকারি বক্তব্যের গোল গোল উত্তর দিয়েছে। যার সারমর্ম কতকটা এরকম: "আমরা যাত্রী সেবায় ব্রতী। তাই যাত্রীরা যাতে উপযুক্ত (পড়ুন সর্বনিম্ন) ভাড়ায় পরিষেবা পান সেই চেষ্টাই আমরা সর্বদা করে থাকি। মাঝে মাঝে চাহিদা বাড়লে আমাদের অতিরিক্ত (পড়ুন সারচার্জ) ভাড়া নিতে হয়। কিন্তু তা তো যাত্রীদের সুবিধার্থেই, যাত্রীদের যেন প্রত্যাখ্যানের নির্মম যন্ত্রণা ভোগ না করতে হয়।"
একটু ভুল বলা হল। 'উত্তর মেলেনি' কথাটা হয়ত ভুল। আসলে উত্তর ছিলই না। অ্যাপ ট্যাক্সি সংস্থাগুলোর কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের হয়ে সাফাই গাইতে পারেন, কিন্তু তাঁরা যে স্বচ্ছ পদ্ধতি মেনে ভাড়া নির্ধারণ করতেন, সে কথা তাঁরা প্রমাণ করতে পারবে না। সংস্থাগুলোর ওয়েবসাইটে অবশ্য একটি ভাড়ার তালিকা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু যাঁরা নিয়মিত ভাবে ওলা বা উবের চড়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাতায়াত করেন তাঁরা খুব ভালোভাবেই জানেন সেই তালিকার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল নেই।
ধরুন আপনি রোজ রুবি থেকে এক্সাইড মোড়ে আসেন। প্রতিটি অ্যাপ ক্যাবের অ্যাপে একাধিক ক্যাটেগরি আছে। আপনি নির্দিষ্ট কোনও একটি ক্যাটেগরি ঠিক করে গাড়ি বুক করার চেষ্টা করে দেখুন, দেখবেন রোজ একই ভাড়া দেখাচ্ছে না। অনেক সময়ই একদিনের থেকে অন্যদিনের ভাড়ার পার্থক্য ২০-৩০ টাকার বেশি, তাও সারচার্জ ছাড়া। এর ব্যাখ্যা আপনি কী ভাবে করবেন?
তর্কের খাতিরে, ধরে নেওয়া যাক ওয়েটিং চার্জের জন্য ভাড়ার এই হেরফের। কিন্তু সেই যুক্তিও খাটছে না। 'স্বচ্ছতার' কথা মাথায় রেখে অ্যাপ ক্যাব সংস্থাগুলো আনুমানিক ভাড়া আগাম জানান। ট্রিপ চালু হওয়ার পর রাস্তা পরিস্থিতি অনুযায়ী কতটা সময় লাগতে পারে সে বিষয় কী ভাবে আগাম নিশ্চিত হচ্ছেন অ্যাপ ট্যাক্সি সংস্থাগুলোর কর্তৃপক্ষ? তাঁরা যে নিশ্চিত নন, তা তো গন্তব্যে পৌঁছলেই জানা যায়।
এখন এসি ট্যাক্সির ভাড়ায় অ্যাপ ক্যাব, সর্বোচ্চ সারচার্জের পরিমাণ মূল ভাড়ার ৪৫ শতাংশ
যেদিন অস্বাভাবিক ট্র্যাফিক বিভ্রাট দেখা দেয় সেদিন আনুমানিক ভাড়া থেকে বেশি টাকাই গুণতে হয় যাত্রীদের।
রাজ্য পরিবহণ দপ্তরকে ধন্যবাদ। হলুদ ট্যাক্সিগুলোর মতো অ্যাপ ট্যাক্সির ভাড়াও এ বার নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এই ভাড়া নির্ধারণের পদ্ধতিটা একেবারে জলের মতো সহজ, যা সহজেই যাত্রীরাও অনুধাবন করতে পারবে।
সরকার জানিয়েছে যে এসি ট্যাক্সির সরকারি স্বীকৃত ভাড়াই অ্যাপ ক্যাবগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ, প্রতি কিলোমিটার ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা। এর সঙ্গে এসি ট্যাক্সির মতো ওয়েটিং চার্জ, নাইট চার্জ ও সার্ভিস চার্জ যোগ করতে পারবে অ্যাপ ক্যাবগুলো। অর্থাৎ, এই চারটি চার্জ - দূরত্ব চার্জ, ওয়েটিং চার্জ, নাইট চার্জ (ক্ষেত্র বিশেষে প্রযোজ্য) ও সার্ভিস চার্জ - যোগ করে যে অঙ্ক দাঁড়াবে তাই অ্যাপ ক্যাবের মূল ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।
সরকারের এই নির্দেশের ফলে অ্যাপ ক্যাবের ভাড়ার কাঠামো অনেকটাই স্বচ্ছতা পেল এবং যাত্রীদের অনেকটাই সুবিধা করে দিল। এর আগে দিল্লি ও কর্নাটক সরকার অ্যাপ ক্যাবের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ ভাড়া বেঁধে দিয়েছে। দিল্লি ও কর্নাটকের মতো পশ্চিমবঙ্গ সরকারও অ্যাপ ক্যাবের সর্বোচ্চ ভাড়া বেঁধে দিয়েছে। মূল ভাড়ার ৪৫ শতাংশ বেশি কোনও মতেই সারচার্জ কার্যকর করতে পারবে না অ্যাপ ক্যাব সংস্থাগুলো।
কিন্তু এখানেই সরকারি সিদ্ধান্তকে ফুল-প্রুফ সিদ্ধান্ত বলে মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
চাহিদা বেশি থাকলে অ্যাপ ক্যাবগুলো আকাশছোঁয়া সারচার্জ নিত। এখন সেই সারচার্জের পরিমাণ বেঁধে দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সারচার্জ কখন কার্যকর করা যাবে সে বিষয় কোনও নির্দিষ্ট মাপকাঠি তৈরি করা হয়নি।
২০০ টাকা ভাড়া ক্ষেত্রে সময় বিশেষে অ্যাপ ক্যাব সংস্থাগুলো সারচার্জ হাঁকিয়ে এই দূরত্বের জন্য ৫০০ টাকাও চাইত। কিন্তু নতুন নির্দেশিকায় এই ২০০ টাকার ভাড়া ২৯০ টাকার বেশি হতে পারবে না। এখন যদি অ্যাপ ক্যাব সংস্থাগুলো প্রতি ক্ষেত্রেই সারচার্জ কার্যকর করে ২৯০ টাকা বা কাছাকাছি কোনও ভাড়া স্থির করে তা হলে তা কী ভাবে আটকান যাবে? কারণ, কোন কোন ক্ষেত্রেকে 'চাহিদাপূর্ণ' ক্ষেত্র বলা হবে, অর্থাৎ সারচার্জ কার্যকর করা যাবে, তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও নির্দেশিকা নেই।
অবিলম্বে এই নির্দেশিকা জারি না করা গেলে যাত্রীদের কিন্তু ভুগতে হবে। কোনও কারণ ছাড়াই সারচার্জ যুক্ত ভাড়ার সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা থাকছে এবং এ জন্য কোনও কারণ ছাড়াই যাত্রীদের গাঁট থেকে অতিরিক্ত পয়সা খরচ করতে হবে।