নোটবন্দি: নগদ সঙ্কটের পর আমাদের মধ্যে কোন কোন নতুন অভ্যাস তৈরি হল

নোটবন্দির পরে নগদ ব্যবহারের অভ্যাস অনেক ক্ষেত্রেই অনেকটা করে কমিয়ে দিয়েছে

 |  4-minute read |   11-11-2018
  • Total Shares

২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর। সন্ধ্যাবেলা পাড়ার প্রতিবেশীরা স্থানীয় ক্লাবে এসে জড়ো হয়েছে। তরুণ সদস্যরা যখন ক্যারম খেলতে ব্যস্ত তখন ক্লাবের প্রবীণ সদস্যরা টেলিভিশন সেট খুলে পুরোনো হিন্দি গানের অনুষ্ঠান শুনছেন। ঠিক সেই সময় বুকুদা এসে খবরটা দিল, "খবর শুনেছো, মোদী ঘোষণা করেছেন আজ থেকে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট অচল।"

তার মানে তো নোটবন্দি! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল ক্লাবের সদস্যদের। আশঙ্কায়, দুরু দুরু বুকে, টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে নিউজ চ্যানেল চালু করা হল। দেখা গেল 'বুকু-দা ইজ রাইট'। নোটবন্দির ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বাড়িতে কয়েকটি পাঁচশো টাকার নোট পড়ে রয়েছে। একটি কী দুটি ১০০০ টাকার নোটও রয়েছে - সেগুলির কী হবে? পাঁচশো বা হাজারের নোট অচল মানে তো চাপ পড়বে ১০০, ৫০ বা ২০ ও ১০ টাকার নোটগুলোর উপর - বাজারে পর্যাপ্ত নগদ পাওয়া যাবে তো?

পরের দিন সংবাদপত্রগুলো থেকে বিস্তারিত ভাবে জানা গেল যে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট ব্যাঙ্কে ফেরত দেওয়া যাবে। রেল টিকিট বুকিংয়ের ক্ষেত্রে বা আরও কয়েকটি সরকারি পরিষেবায় আরও কিছুদিনের জন্য ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের বিনিময়ে পরিষেবা পাওয়া যাবে। অন্যদিকে কয়েকদিনের মধ্যে নগদ নিয়ে যে বেশ চাপে পড়তে হবে সেই আশঙ্কা দিন দুয়েকের মধ্যেই সত্যি হল।

body_111118063538.jpgনোটবন্দি ঘোষণার দিন দুয়েকের মধ্যেই নগদ সঙ্কট দেখা দিয়েছিল

দিনটি ছিল ১১ নভেম্বর। হন্যে হয়ে একটার পর একটা এটিএমে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ইংরেজিতে যাকে বলে 'রানিং ফ্রম পিলার টু পোস্ট'। কিন্তু কোনও এটিএমেই নগদ নেই। মনে পড়ে গেল, বছর দশেক আগে পুরুলিয়ার এক সন্ধ্যার কথা। সেদিন সেই অজ পাড়াগাঁয়ে বেড়াতে গিয়ে ১০০ টাকার জন্য রীতিমতো কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত, শহরে ফিরে টাকা ফেরত দিতে হবে - এই প্রতিশ্রুতিতে, শদুয়েক টাকা ধার দিয়েছিলেন এক সহযাত্রী।

২০০৫ সালের পুরুলিয়ার সন্ধ্যাবেলায় অভিজ্ঞতা তো ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে খাস কোলকাতায়। এখন উপায়?

আরও মাস দুয়েক মতো চলেছিল এই পরিস্থিতি। আর, এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েকটি বিকল্প পথ বেছেও নেওয়া হয়েছিল। বলা ভালো বেশ কয়েকটি নতুন নতুন অভ্যাস আমদানি করতে হয়েছিল।

নোটবন্দির দু'বছর পর এর মধ্যে কয়েকটি অভ্যাস রয়ে গিয়েছে। কয়েকটি অভ্যেস আমরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুলেও গিয়েছি।

১) কার্ড সোয়াইপিং

কার্ড সোয়াইপ করে পরিষেবা নেওয়ার অভ্যাস একশ্রেণীর ক্রেতার মধ্যে আগে থেকেই ছিল। মোদীর নোটবন্দির ঘোষণার পর নগদ সঙ্কট দেখা দিতে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড সোয়াইপ করে পণ্য ও পরিষেবা ক্রয় করার প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য ক্রেতাদের থেকে দোকানদার বা যাঁরা পরিষেবা দিচ্ছেন তাঁদের গরজ বেশি ছিল। নগদ পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং নেই মামার চেয়ে কানামামা ভালো। নগদ না পাওয়া যাক দোকানের নামে তো ক্রেডিট অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তাহলে একটা পিওএস (পয়েন্ট অফ সেল বা যেখানে কার্ডে টাকা মেটানো যায়) মেশিন লাগাতে সমস্যা কোথায়?

তবে যে সব পরিষেবা ক্ষেত্রে পরিষেবাদাতাদের লাভের অংশ খুব কম (যেমন আপনি যখন ট্রাভেল এজেন্টদের কাছ থেকে বিমান টিকিট কিনছেন) সেখানে এই প্রবণতা একেবারেই বৃদ্ধি পায়নি। কারণ পিওএস যন্ত্র ব্যবহার করলে পরিষেবাদাতাদের কাছ থেকে প্রতি লেনদেনে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ধার্য করে ব্যাঙ্ক। যে পরিষেবায় লাভ যৎসামান্য বা একেবারেই নেই সেই পরিষেবা দেওয়ার সময় যদি কার্ড সোয়াইপ করা হয় তাহলে ক্রেতাদের কাছ থেকেই ট্রানজাকশন চার্জটা চাওয়া হয়ে থাকে। সেই কারণে ক্রেতারা এই ক্ষেত্রগুলোতে কার্ড সোয়াইপ করতে চান না। কে আর খামোকা নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করতে চান?

২) ফান্ড ট্রান্সফার

এ জন্য অন্য উপায় আছে। আর সেই উপায় নোটবন্দির পর থেকে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে - ফান্ড ট্রান্সফার। এই পরিষেবা নিতে গেলেও ক্রেতাদের তাদের সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ককে সামান্য একটি চার্জ দিতে হয় ট্রানজাকশন পিছু। তবে এর অঙ্ক অতি নগণ্য। সবচেয়ে বড় বিষয় ফান্ড ট্রান্সফার প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে আইএমপিএস বলে একটি প্রক্রিয়া রয়েছে, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খুব বেশি হলে ৩০ মিনিটের মধ্যে আপনি একটি অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে পারেন। তাও রবিবার ও অন্যান্য ছুটির দিনে। স্বভাবতই, এই প্রক্রিয়াগুলো বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল নোটবন্দি ঘোষণার পর পর। আজও এই প্রক্রিয়াগুলো জনপ্রিয় রয়ে গিয়েছে।

তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে স্বভাব বদল হয়েছে বৈকি। নোটবন্দির পর অনেকেই (যেমন পাড়ার ছোট মুদির দোকান) ইচ্ছে না থাকলেও নিয়মিত ক্রেতাদের ক্রেডিট বা সেভিংস অ্যাকাউন্ট নম্বর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেকে আবার পেটিএমের মতো ই-ওয়ালেট পরিষেবা চালু করেছিলেন, ইচ্ছে না থাকলেও। ওই যে নেই মামার চেয়ে কানামামা ভালো। নগদ নেই তাই নিজের অ্যাকাউন্টে যদি টাকা ট্রান্সফার করে নেওয়া যায়। কিন্তু নগদ সমস্যা মিটতেই এই শ্রেণীর পরিষেবাদাতারা আবার ফিরে গিয়েছেন পুরোনো অভ্যাসে। ফেল নগদ মাখ তেল।

৩) অনলাইন ট্রানজাকশন

শেষ তিন বছরে বেশ কয়েকটি অনলাইন পোর্টাল চালু হয়েছে ভারত জুড়ে। হোটেল বুকিং থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক ক্রয় বিক্রয় এমনকি মাছ-মাংস আনাজপাতি ও মসলাপাতির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সবকিছুর জন্যেই অনলাইন পোর্টাল ও মোবাইল অ্যাপ চালু হয়েছে। আর এই পরিষেবাগুলোতে আপনি ওনলাইন ট্রানজাকশনের মাধ্যমে দাম মেটাতে পারেন। তাও একেবারে নিখরচায়। বাড়িত পয়সা যদি নাই লাগে তাহলে এটিএমে আর খামোকা যেতে যাবেন কেন? সবচেয়ে বড় কথা নগদ দিতে গেলে খুচরোর সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই পরিষেবায় সেই সবের বালাই নেই।

স্থানীয় পরিবহণ পরিষেবার ক্ষেত্রেও ওলা উবেরের মতো অ্যাপ ক্যাব বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। আর এই পরিষেবাতেও আপনি অনলাইন ট্রানজাকশনের মাধ্যমে ভাড়া মেটাতে পারছেন। ট্যাক্সিকে পিছনে ফেলে ওলা উবেরের জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠার এটাও একটা বড় কারণ।

body1_111118063636.jpgনোটবন্দির পর অনলাইন ট্রানজাকশনের চল বেড়েছে

বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য কোনও হেরফেরই ঘটেনি। যেমন শহরের হলুদ ট্যাক্সি, অটো ও বেসরকারি বাস পরিষেবার ক্ষেত্রে। তাও কিছু ট্যাক্সি চালক বা অটো চালক নোটবন্দির ঠিক পরে পরেই ওয়ালেট মাধ্যম ভাড়া নেওয়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা আর অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়নি। বেসরকারি বাস তো এই চেষ্টা কোনও দিনও করেনি।

নোটবন্দি সত্যি সত্যি কালো টাকা উদ্ধার করতে পেরেছে কিনা বা নোটবন্দি সত্যি সত্যি কালো টাকা জমানোর প্রবণতা কমাতে পেরেছে কিনা কিংবা নোটবন্দির সিদ্ধান্ত ঠিক কতটা কার্যকর হয়েছে এই প্রসঙ্গে বা এই বিতর্কে ঢুকছি না। কিন্তু একটা কথা অনস্বীকার্য - নোটবন্দি নগদের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ARPIT BASU ARPIT BASU @virusfound007

Arpit Basu is the Special Correspondent with the India Today Group’s fact check team. With more than one-and-a-half decade's experience in print and digital media, he has reported on aviation, transport, crime, civic and human interests issues. His sting operation on how precious Aviation Turbine Fuel, meant for Kolkata airport, was pilfered and sold in local market as ‘white kerosene’ received widespread acclaim. Arpit has worked with reputed media houses like The Times of India and Hindustan Times and had received letter of appreciation for reporting during the Phalin cyclone in Odisha in 2013.

Comment