সেন্টিনেলিজদের ধর্মান্তকরণ চাউয়ের একার কর্ম নয়, বিশ্বজুড়েই এই প্রচেষ্টাই চলছে
চাউয়ের মতো যীশুর দূত সঙ্গে থাকলে স্বয়ং ঈশ্বরও শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর আশ্বাস দিতে পারবেন না
- Total Shares
সম্প্রতি মার্কিন মিশনারি জন অ্যালেন চাউ আন্দামানের সেন্টিনেল দ্বীপে দুঃসাহসিক অভিযানে গিয়েছিলেন। মনে করা হচ্ছে, দ্বীপে বাস করা সেন্টিনেলিজ জনজাতির লোকেরা তাঁকে হত্যা করেছেন। এই বেদনাদায়ক ঘটনার কথা কানে আসতেই আমার রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের একটি বিখ্যাত কবিতার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল - 'ওয়াইট ম্যান'স বার্ডেন'। এক বছরেরও বেশি সময়ে আগে এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতের একটি প্রত্যন্ত দ্বীপে ঘটে যাওয়ার এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় গোটা বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথাই প্রকাশ পাচ্ছে। ঘটনাটির থেকে আরও একটি বিষয়ও পরিষ্কার - মনুষ্য সমাজের সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষই।
সংস্কৃতিকে ধ্বংসের প্রচেষ্টা
পনেরো শতাব্দীতে এই 'ওয়াইট ম্যান'স বার্ডেন' পড়েই ক্রিস্টোফার কলম্বাস জাহাজে পাড়ি দিয়েছিলেন। চলতে চলতে তিনি একটি অজানা ভূমিতে পৌছিয়ে যায়। পরবর্তীকালে যে ভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়। কলম্বাসের এই আমেরিকার মাটিতে পা রাখার ফলে সেখানকার স্থানীয় সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা একেবারে নির্মূল হয়ে গিয়েছিল।
জন চাউ একটি তিন সপ্তাহব্যাপী কোর্স করে সেন্টিনেল দ্বীপে গিয়ে ছিলেন [সৌজন্য: ইন্ডিয়া টুডে]
খ্রিস্ট ধর্মের চিরাচরিত নীতির কথা ভেবেই আমেরিকায় পা রেখে কলম্বাস জানিয়েছিলেন, "আমি জানতাম এখানে কিছু মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে যাদের এক হয় ভালোবাসা দিয়ে না হলে বলপূর্বক খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী করে তোলা যাবে।"
বাকিটা ইতিহাস।
আমাদের ঘরের কাছে এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে। সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স ১৫৪২ সালে গোয়াতে এসেছিলেন। তাঁর গোয়া আগমনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বলপূর্বক স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমানদের খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী করে তোলা এবং স্থানীয় সংস্কৃতিকে তছনছ করে ফেলা।
১৫৪৬ সালে পর্তুগালের রাজা একটি ফতোয়া জারি করেন। সেই ফতোয়ায় বলা হয়েছিল, হিন্দুধর্ম মুছে ফেলতে হবে, হিন্দু মন্দির ধ্বংশ করতে হবে, হিন্দুদের উৎসব উদযাপন বন্ধ করে দিতে হবে এবং হিন্দু পুরোহিতদের উৎখাত করতে হবে।
'হাউসেস অফ গোয়া' নামের একটি বইয়ের ভূমিকায় হেলা পন্ডিত ও অ্যানাবেল মাসক্যারানাস লিখেছেন, "পরের ২৬০ বছর ধরে প্রচুর লোককে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। বহু মন্দির ভেঙে গির্জা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। হিন্দু পুরোহিতদের ধর্মীয় রীতি পালন করতে দেওয়া হয়নি। তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাঁদের নির্বাসনেও পাঠানো হয়েছিল।"
দেশের অমূল্য ধন সম্পদ গ্রাস করার পাশাপাশি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পত্তনের আরও একটি লক্ষ ছিল - এ দেশে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও খ্রিস্ট ধর্মের আধিপত্য বিস্তার করা। বৃটিশ সরকারের অধীনে একটি আলাদা দপ্তর ছিল যেটি মূলত ইংরেজ বিষয়ক ব্যাপারগুলো দেখত। এই দপ্তর মারফত প্রচুর পরিমাণ অর্থ ভারতের গির্জাগুলোকে দেওয়া হত।
ধর্মান্তরে অগাধ বিশ্বাস
কিপলিংয়ের সেই কবিতা, 'ওয়াইট ম্যান'স বার্ডেন', ফিলিফিন্স-আমেরিকা যুদ্ধের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এই কবিতায় কবি ফিলিপিন্সের ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানিয়েছেন।
এর পরেই 'দ্য ওয়াইট ম্যান'স বার্ডেন' ঔপনিবেশিক বা সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হয়ে ওঠে।
এই ধর্মান্তকরণের প্রচেষ্টা কিন্তু চাউয়ের একার নয়
বিশ্বের সাদা মানুষরা মনে করেন যে সাদা চামড়া নেই এমন মানুষদের এবং খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী নয় এমন মানুষদের সংস্কারসাধন করাটা তাঁদের ধর্মীয় কর্তব্য।
একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন - ২৬বছরের চাউ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত তাঁর বাড়ির সমস্ত রকম আরাম ত্যাগ করে বারংবার সেই নিষিদ্ধ দ্বীপের উদ্দেশ্যে ছুটে যাচ্ছিলেন কেন?
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত খ্রিস্ট ধর্ম বিষয়ক একটি সংস্থা 'অল নেশনস'এর অধীনে একটি তিন সপ্তাহ ব্যাপী কোর্স করেছিলেন তিনি। এই কোর্সটি কিছুটা গোপিনীয়তা অবলম্বন করেই অনুষ্ঠিত করা হয়। কী ভাবে একটি প্রত্যন্ত দ্বীপে প্রবেশ করে সেখানকার স্থানীয়দের মন জয় করে তাঁদের খ্রিস্ট ধর্মে রুপান্তরিত করা যায় মূলত সেই শিক্ষাই এই কোর্সে দেওয়া হয়ে থাকে।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে এই সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনে বুক অফ ম্যাথিউ থেকে দুটি লাইন লেখা হয়েছিল, "যাও, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে নিজেদের অনুগামী তৈরি কর। বাবা, পুত্র ও ঈশ্বরের নামে শপথ করিয়ে তাদের বাপ্তাইজ কর। যাও, আমার কাছে যে শিক্ষা পেয়েছি সেই শিক্ষায় ওদেরও শিক্ষিত করে তোলো।" চাউয়ের অনেক বন্ধুই নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন যে চাউ ঠিক এই আজ্ঞাটাই বহন করছিলেন।
ধর্মান্তকরণ কর্মসূচি
সেন্টিনেলিজদের ধর্মান্তকরণের প্রচেষ্টা একা চাউয়ের নয়। গোটা বিশ্বই খ্রিস্ট ধর্ম প্রসারের জন্যে এই প্রচেষ্টা করে চলেছে।
এই ঘটনায় আলেক্সান্ডার নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চাউ তাঁর নোটবুকে পোর্টব্লেয়ারে বসবাসকারী এই ব্যক্তিকে 'এ' বলে সম্বোধন করেছিলেন। জেরায় আলেক্সান্ডার পুলিশকে জানিয়েছেন যে আরও দু'জন মার্কিন নাগরিক আন্দামানের একটি সেফ হাউসে এই অভিযান সংক্রান্ত কয়েকটি বৈঠক করেছিলেন।
'অল নেশনস'এর তরফ থেকেও একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে বিশ্বের যে প্রান্তে খ্রিস্ট ধর্মের উপস্থিতি নেই সেই প্রান্তে খ্রিস্ট ধর্মের বাণী পৌছিয়ে দিতে ও গির্জা প্রতিষ্ঠা করতে তারা বদ্ধপরিকর। এই বিবৃতিতে চাউকে যীশু খ্রিস্টের একজন 'অন্ধ ভক্ত' ও ' সুযোগ্য দূত' হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে।
একটা বিষয়ে এখন প্রমাণিত। যীশুর দূত কিন্তু এই নিষিদ্ধ দ্বীপে যাওয়ার জন্যে মৎস্যজীবিদের ঘুষ দিতে কিংবা ভারতের বেশ কয়েকটি আইনভঙ্গ করতেও পিছপা হননি।
এমন 'ভক্ত' সঙ্গে থাকলে স্বয়ং ঈশ্বরও কি শান্তিপূর্ন পৃথিবীর আশ্বাস দিতে পারবেন?
(সৌজন্য: মেল টুডে)
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে