দুর্গাপুজোয় সব ক্লাবকে ১০,০০০ টাকা করে না দিয়ে প্রয়োজন বুঝে দেওয়া যেত
এক উদ্যোক্তার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, অন্যজন এই টাকায় 'খানাপিনা'র আয়োজন করে
- Total Shares
বছর দশেক আগেও অঞ্চলটিকে শহরতলি হিসেবে গণ্য করা হত। ২০১০ সালে পুরসভা নির্বাচনের আগে অঞ্চলটি কলকাতা পুরসভার অধীনে অন্তর্ভুক্ত হয়। এর ঠিক এক বছরের মাথায় কলকাতা পুলিশের এলাকা বিন্যাসের সময়ে অঞ্চলটি কলকাতা পুলিশের আওতায় আসে। এখন এলাকাবাসী নিজেদের পুরোদস্তুর কলকাতাবাসী হিসেবে দাবি করেন।
এই অঞ্চলের ঢিল ছোড়া দূরত্বের মধ্যে দু'দুটি পুজো মণ্ডপ-- একটির পুজোর বাজেট গত আট বছরে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২১ লক্ষ টাকা মতো। এই পুজোর অধিকাংশ উদ্যোক্তা পাড়ায় তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। অনেকেই আবার পাড়ার সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত। সবমিলিয়ে খুব সহজেই প্রতি বছর পুজোর বাজেট উত্তরোত্তর বাড়িয়ে নেওয়া গিয়েছে।
এ বছর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন প্রতিটি পুজো কমিটিকে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। কিন্তু, একটি ২১ লক্ষের দুর্গাপুজোর কাছে এই অনুদান তো নস্যি। এই ১০ হাজার টাকা দিয়ে কী করা হবে? উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, "পুজোর দিন কয়েক বাদে পুজোর সঙ্গে যুক্ত সক্রিয় সদস্যদের 'খানাপিনা'র ব্যবস্থা করা হবে এই টাকা দিয়ে।"
অন্য পুজো কমিটির অবস্থা অবশ্য একেবারেই ভিন্ন। আসলে এই পুজোতে সক্রিয় রাজনীতি করেন এমন কেউই নেই। পাড়ার মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীরা মিলে এই পুজোর আয়োজন করেন। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে চাঁদা তুলতে বেরোন। কাজের জগতে নব আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে নিজেদের যৎসামান্য পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে ডোনেশন আদায় করা। এই দুইয়ের যোগফলে যা দাঁড়ায় তাই দিয়ে হবে পুজো। অধিকাংশ বছরে পুজোর শেষে বছর ভর ক্লাবঘরের রুক্ষণাবেক্ষণ বা উন্নয়নের জন্য পয়সা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।
এই অনুদান ছোট পুজো কমিটিগুলোর নিতান্ত প্রয়োজন, বড় কমিটিগুলোর নয় [ছবি: পিটিআই]
তাই নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাদের পুজো সংসারে। কমিটির বৈঠকে ঠিক হয়েছে সাত লক্ষ টাকা খরচ করা হবে এ বছর। ক্লাবের ভাঁড়ারে রয়েছে সাড়ে চার লক্ষ টাকা মতো। বাকি আড়াই লক্ষ জোগাড় করতে এখন উঠে পড়ে লেগেছে উদ্যোক্তারা। জোগাড় করা যাবে, এমন নিশ্চয়তা এখনও পাওয়া যায়নি। তাই আপাতত চেপেচুপে খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুজো কমিটি। পুজো যত এগোবে টাকার জোগান বুঝে খরচ সেই অনুপাতে ঠিক করতে হবে।
দিদির এই ১০,০০০ টাকা এখন তাদের কাছে অনেকটা আশীর্বাদের মতো। এক কথায় ১০,০০০ টাকা বের করে দেওয়ার মতো লোকের তাদের বড়ই অভাব। কিছু পয়সাওয়ালা লোকেদের কাছে বারংবার দরবার করে কিছু মোটা টাকা আসে। কিন্তু তার পরিমাণ কখনই ১০ হাজার হয় না। তাই উদ্যোক্তারা এখন এই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা সুযোগটা কাজে লাগাতে মরিয়া। যে কোনও প্রকারে এই ১০ হাজার টাকা তাদের পেতেই হবে। এবং এর পুরোটাই যে 'পুজোর কাজে' লাগবে তা বলাইবাহুল্য।
এই পুজোর উদ্যোক্তাদের অনেকেই আবার 'দিদির ভেট'কে একটু অন্যভাবে দেখছেন। গত বছরের মহরমের জন্যে প্রতিমা বিসর্জন একদিন পিছিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। একদিন বেশি প্রতিমা রাখার জন্য প্রায় হাজার দশেক মতো বেশি গচ্চা গিয়েছিল। তাই উদ্যোক্তাদের অনেকেই মনে করছেন সেই 'ফালতু' খরচ এবার অনুদান হিসেবে ফিরিয়ে দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
যাই হোক না কেন, এই দু'টি পুজো কমিটির পরিস্থিতি থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার। কলকাতায় এক শ্রেণীর পুজো কমিটির কাছে এই দশ হাজার টাকা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। এই টাকা পেল কী পেল তা দিয়ে এই পুজো কমিটিগুলোর মাথা ব্যথা থাকার কথা নয়। নেইও। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা তাই এই টাকা নিয়ে পুজোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত নয় আবার পুজো সংক্রান্ত কোনও একটি বিষয় খরচ করে দিলেই হয়। অনুষ্ঠান বাড়ির বাড়তি খাবারের যা পরিণতি হয় আর কি! অন্যদিকে আর এক শ্রেণীর পুজো কমিটি রয়েছে যাদের এই অর্থের সমূহ প্রয়োজন। কন্যা দায়গ্রস্ত এক দরিদ্র পিতার বিয়ের আগের দিন লটারি জিতে ফেলার মতো।
দুস্থ, দরিদ্র, বেকার বা পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা থাকে। গোটা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও বিপিএল রেশন কার্ডের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এই ধরণের প্রকল্প বা অনুদান তো নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য, যাদের সত্যিই এই সাহায্যের প্রয়োজন।
তাই প্রশ্ন উঠছে, দুর্গাপুজোর সরকারি অনুদান কেন সকলের জন্যে বরাদ্দ থাকবে? শুধুমাত্র যাদের প্রয়োজন তাদের জন্যে নয় কেন? দশ হাজার টাকা করে সকলের মধ্যে বিলিয়ে না দিতে শুধুমাত্র যাদের প্রয়োজন তাদেরই দেওয়া যেতে পারত। এতে হয়ত দুটি সুবিধা হতো। যাদের নিতান্তই প্রয়োজন তারা আরও কিছু বেশি টাকা পেতেন। হয়ত সব মিলিয়ে সরকারি কোষাগার থেকেও এই খাতে খরচ হওয়া টাকার পরিমাণ অনেকটাই কম হত।
কী আর করা যাবে? ভোটের দায়ে বড় দায়ে। অপাত্রে ব্যয় হয় হোক, ভোটারদের খুশি রাখতে হবে তো! সরকারি টাকা খরচ করে সরকার বাঁচানো বা সরকার গঠন করাই তো আসল লক্ষ্য।