দেশের মধ্যে কলকাতা বিমানবন্দরকে কেন বেশি পছন্দ করে চোরাচালানকারীরা?

মামলা রুজু না করে কেন চোরাই মালের ব্যাগ ফেলে দেওয়া হয়েছিল খালে?

 |  4-minute read |   17-07-2018
  • Total Shares

বছর আটেক আগেকার ঘটনা। বিমানবন্দরের ভিতরে একটি বেসরকারি বিমানের কর্মীকে ঘিরে ফেলেছিলেন তাঁরই সহকর্মীরা। ওই ভদ্রলোকের হাতে একটি কালো রঙের ব্যাগ পাওয়া যায় আর সেই ব্যাগ থেকে উদ্ধার হয় কয়েক গোছা জাল ভারতীয় নোট (এফআইসিএন) ও একটি নামী সংস্থার লোগো লাগানো কয়েকশো মেমোরি চিপস, যা কলকাতার কয়েকটি বাজারে চড়া দামে (যে দামে মেমোরি চিপ প্রস্তুতকারক সংস্থাটি নিজেদের তৈরি করা মেমোরি চিপসগুল বিক্রি করে) বিক্রি করবার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল। এর পর বিমানকর্মীরা ওই তাঁদের ওই সহকর্মীকে সেই ব্যাগ-সহ শুল্ক দপ্তরের আধিকারিকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

সরকারি ভাবে কোনও মামলা রুজু হলে বিমানসংস্থাটিও বিপদে পড়তে পারত। তাই সেই কর্মীর বিরুদ্ধে বিমান সংস্থাটির পক্ষ থেকে কোনও অভিযোগ জানানো হয়নি। শুল্ক দপ্তরের কর্তারাও কোনও স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করেননি। সংশ্লিষ্ট কর্মীটিকে বরখাস্ত করে মামলাটিকে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল আর ওই কালো রঙের ব্যাগটিকেও মাল সমেত ফেলে দেওয়া হয়েছিল বিমানবন্দরের নিকটবর্তী একটি খালে।

কিন্তু আজও বিমানবন্দরের ইতি-উতিতে কান পাতলেই এই খবরটি শোনা যায়। বিভিন্ন বিমানসংস্থা ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মচারীরা এই ঘটনাটি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।বিমানসংস্থার আধিকারিকটি আসলে করতে কী চাইছিলেন?

body1_071718011615.jpgব্যাঙ্কক ও কুয়ালা লামপুরগামী বিমানগুলোর উপর অন্যান্য দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নজরদারি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেকটাই শিথিল থাকে

ওই ব্যাঙ্কক-কলকাতা বিমানের এক যাত্রী ব্যাঙ্কক থেকে ওই জাল টাকা আর মেমরি চিপ কলকাতায় পাচার করছিলেন। কিন্তু বিমান থেকে নামার সময় সেই যাত্রী ইচ্ছে করেই হ্যান্ডব্যাগেজ নিয়ে নামেননি। বিমান সংস্থার কর্মীটির উপর দায়িত্ব ছিল তিনি যেন ওই ব্যাগটি নামিয়ে বিমানবন্দরের ভিতর দিয়ে হেঁটে ডোমেস্টিক ট্যার্মিনালের বাইরে অপেক্ষা করবেন। ততক্ষণে ওই যাত্রী অবলীলায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পেরিয়ে বাইরে চলে আসবেন। কারণ তাঁর কাছে তখন আর বেআইনি কিছুই থাকবে না। ডোমেস্টিক ট্যার্মিনালের বাইরে আবার সেই ব্যাগ হাতবদল হবে।

এই ভাবেই প্রায় নিত্যদিন কলকাতার বিমানবন্দর থেকে বেআইনি ভাবে পণ্য পাচার হয়ে চলেছে। আইনের পরিভাষায় যাকে 'স্মাগলিং' বলে। কখনও জাল নোট, কখনও কেটমাইন পাউডার নামক একটি মাদকদ্রব্য, কখনও সোনা আবার কখনও ইলেক্ট্রনিক জিনিস। দেশের আর পাঁচটা আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরের তুলনায় কলকাতা বিমানবন্দরের যাত্রী বা বিমান সংখ্যা অনেকটা কম হলেও, পণ্য পাচারের বিষয় কলকাতা বিমানবন্দর বেশ 'কুখ্যাত' এবং চোরা কারবারিদের কাছে কলকাতা বিমানবন্দর এতটা পছন্দের হয়ে ওঠার পিছনে বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে।

যেমন ধরুন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিমান ওঠানামার ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে। পাকিস্তানের করাচি ও লাহোর বিমানবন্দর এবং ভারতের দিল্লি, চণ্ডীগড় ও মুম্বাই বিমানবন্দর ছাড়া আর কোনও বিমানবন্দরে দুই দেশের মধ্যে চলাচল করা বিমানগুলো ওঠানামা করতে পারে না। শুধু বিমান ওঠা-নামার উপর নয়, দুই দেশের নাগরিকদের অভিবাসন ছাড়পত্র পাওয়ার উপরও বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পাকিস্তান বা ভারতীয় নাগরিকরা দু'দেশের এই পাঁচটি বিমানবন্দর ছাড়া একে অপরের দেশে প্রবেশের ছাড়পত্র পান না। এই আইনের বেড়াজালে একবার প্রাক্তন পাকিস্তান অধিনায়ক আসিফ ইকবালকেও কলকাতা বিমানবন্দরে রাত্রিযাপন করতে হয়েছিল।

বিমান চলাচল বা অভিবাসন ছাড়পত্রেই যদি এতটা কড়াকড়ি থাকে তা হলে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে চলাচল করা বিমানগুলো ও তার যাত্রীদের উপর নিরাপত্তা কতটা জোরদার থাকে তা একবার আন্দাজ করে দেখুন। শুধু পাকিস্তান নয়, ভারত থেকে চিন ও মধ্য এশীয় দেশগুলোর মধ্যে যে বিমানগুলো চলাচল করে সেই বিমানগুলোর উপরও বাড়তি নজরদারি থাকে দু'দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর।

তাই পাচারকারীরা চেষ্টা করেন অন্য কোনও দেশ হয়ে পাচারের পণ্য নিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রথম পছন্দ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। মোটামুটি সব দেশের সঙ্গেই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এই ছোট ছোট দেশগুলোর সম্পর্ক ভালো। তাই ব্যাঙ্কক বা কুয়ালা লামপুরগামী বিমানগুলোর উপর অন্যান্য দেশগুলোর নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নজরদারি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেকটাই শিথিল থাকে এবং পাচারকারীরা এই সুবিধাটাই নেয়।

উল্টোদিকে ব্যাঙ্কক, কুয়ালালামপুর বা সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বেশ শিথিল। তাই পাচারকারীরা এই দেশগুলো হয়ে ভারতে প্রবেশ করতে বেশি পছন্দ করেন। যেহেতু কলকাতা বিমানবন্দর দেশের অন্যান্য বিমানবন্দরগুলো থেকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর খুব কাছে তাই কলকাতা বিমানবন্দর পাচারকারীদের প্রথম পছন্দ। তাঁরা বিভিন্ন কৌশলে শুল্ক দপ্তরের আধিকারিকদের ফাঁকি দিয়ে বিমানবন্দরের নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেদ করে বেআইনি মাল নিয়ে শহরে (দেশে) ঢুকে পড়ে।

দ্বিতীয় কারণ বিমানসংস্থার কর্মীদের বা বিমানবন্দরের কর্মীদের সহজেই এই কাজে যুক্ত করা যায়। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বা বিমানসংস্থার কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি কাজের জন্য কোনও তৃতীয় সংস্থাকে আউটসোর্স করে থাকে। এই আউটসোর্স করা সংস্থার কর্মীদের বেতন খুবই কম। অনেক সময়তেই দেখা যায় যে শহরের অন্যান্য যে সব বাজারে বিদেশি পণ্য পাওয়া যায় সেই সব বাজারের দোকানিরা এই সংস্থাগুলোর কর্মীদের স্বল্প খরচে নিয়োগ করেন। ছুটি নিয়ে এই কর্মীরাই তাঁদের দোকানদারের হয়ে ব্যাঙ্কক বা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে পণ্য কিনে (আমদানি) করে নিয়ে আসেন। এই কর্মীরাই খুব সহজে চোরা চালানকারীদের প্রলোভনে পা দেন।

body_071718011727.jpgদেখা গেছে বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা সংস্থার কর্মীরাও চোরাকারবারিদের সঙ্গে যুক্ত থাকে

শুধু কর্মচারী নয়, দেখা গেছে বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা সংস্থার কর্মীরাও এই ধরণের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে।

একটা সময় কলকাতা বিমানবন্দর থেকে প্রচুর পরিমাণ কেটামাইন পাউডার চোরাচালান করা হত। মূলত চেন্নাই থেকে সড়কপথে কলকাতায় এনে এই পাউডার বিমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পাঠানো হয়। সেখানকার নাইটক্লাবগুলোতে এই পাউডার নেশার দ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বেশ কয়েক বছর আগে কুয়ালা লামপুরগামী একটি বিমান থেকে শুল্কদপ্তরের আধিকারিকরা এই কেটামাইন পাউডার ব্যবসার পাণ্ডাকে আটক করেন।

এর পর জেরার সময় বিমানবন্দরে শুল্ক্ দপ্তরের জন্য নিৰ্দিষ্ট ঘরে উপস্থিত হন অভিবাসন দপ্তরের এক কর্তা। এই পাণ্ডার অভিবাসন বাতিল করতে হবে বলে বলে পাণ্ডাকে নিজেদের হেপাজতে নেয় অভিবাসন দপ্তর। কিছুক্ষণ বাদে খবর ছড়ায় যে এই ব্যক্তি নাকি শৌচালয় যাওয়ার নাম করে বিমানবন্দর থেকে পালিয়ে গেছে। পরে তদন্তে (সিসিটিভি ফুটেজে) উঠে আসে যে অভিবাসনের এক কর্তাই নাকি এই ব্যক্তিকে নিজের দায়িত্বে সঙ্গে থেকে বিমানবন্দর থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

চোরাকারবারীদের কাছে কলকাতা বিমানবন্দরকে ব্যবহার করে পণ্য পাচারের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এর পর আবার বিমানবন্দরের ভিতরকার লোকেদের সহজেই প্রলোভন দেখানো যায়। সর্ষের ভিতরেই ভূত লুকিয়ে, তাই কলকাতা বিমানবন্দর বেশি পছন্দ চোরাচালানকারীদের।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ARPIT BASU ARPIT BASU @virusfound007

Arpit Basu is the Special Correspondent with the India Today Group’s fact check team. With more than one-and-a-half decade's experience in print and digital media, he has reported on aviation, transport, crime, civic and human interests issues. His sting operation on how precious Aviation Turbine Fuel, meant for Kolkata airport, was pilfered and sold in local market as ‘white kerosene’ received widespread acclaim. Arpit has worked with reputed media houses like The Times of India and Hindustan Times and had received letter of appreciation for reporting during the Phalin cyclone in Odisha in 2013.

Comment