গেরুয়া শিবিরের বঙ্গ দখলের লড়াইকে কী ভাবে টেক্কা দিচ্ছেন মমতা
বঙ্গ রাজনীতিতে যোগ হল নবতম রাজনৈতিক হাতিয়ার - বাঙালির অতিপ্রিয় ইলিশ মাছ
- Total Shares
বাংলার রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে বিজেপির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণের খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। বহু যুগ ধরেই বঙ্গসমাজ বিশ্বাস করত যে বিজেপি মাত্রই গোবলয়ের দল, যে দলে শুধুমাত্র হিন্দিভাষীদেরই আধিপত্য। বিজেপিও তাদের পশ্চিমবঙ্গের ভোটবাক্সে শুধুমাত্র অবাঙালিদের ভোটকেই গণ্য করত।
এখন অমিত শাহের শয়নে, স্বপনে, জাগরণে শুধুই পশ্চিমবঙ্গ। তাই বঙ্গ সমাজের মন জয় করতে মরিয়া বিজেপি। আর, বঙ্গসন্তানদের মন জয় করতে সংখ্যালঘু তোষণ, বাংলদেশি অনুপ্রবেশকারী বা হিন্দুত্ববাদের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোই বিজেপির হাতিয়ার।
বঙ্গবাসীর মন জয় করতে মরিয়া অমিত শাহ [ছবি: পিটিআই]
কিছুদিন আগে কলকাতায় একটি জনসভায় অমিত শাহ বলেছিলেন, "দেশের ১৯টি রাজ্যে বিজেপি সরকার রয়েছে। কিন্তু দলের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নিজের রাজ্যে সরকার গঠন করতে না পারলে অন্য রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলো অর্থহীন হয়ে পড়বে।"
বিজেপি এখন শ্যামাপ্রসাদের জীবনকাহিনি তুলে ধরে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কী ভাবে দেশভাগের সময়ে হিন্দুদের রক্ষা করেছিলেন তা প্রচার করতে চাইছে। এই প্রচারের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালিদের মন জয় করতে চাইছে বিজেপি। এমনিতেই দেশভাগের বেদনাদায়ক ইতিহাস নিয়ে বেশ স্পর্শকাতর বাঙালিরা। এ বার সেই ইতিহাসকে আবার তুলে ধরে বাঙালির মননে আঘাত করতে চাইছে বিজেপি, যা তিন দশকের বাম সরকারের আমলে অনেকটাই ভুলে গিয়েছিল বাঙালি।
গত দু'বছর ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দিয়ে আসছেন যাতে রামনবমী ও হনুমানজয়ন্তীর মতো হিন্দু উৎসবগুলো এ রাজ্যে আরও বেশি করে উদযাপন করা হয়। এই দুই উৎসবই রাজ্যে প্রভাব বিস্তারে সঙ্ঘ পরিবারের প্রধান ধর্মীয়-রাজনীতির মঞ্চ ছিল।
বিজেপির যোগ্য জবাব দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় [ছবি: পিটিআই]
এদিকে অসমের এনআরসি রিপোর্ট তৃণমূলনেত্রীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। রিপোর্টের বিরোধিতা করে তৃণমূল জানিয়েছে যে বিজেপি "অসম থেকে বাঙালিদের হটিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে।"
অসমের বাঙালি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকের পরে মমতা জানিয়েছিলেন, "এনআরসির তালিকা থেকে মোট ৩৮ লক্ষ বাঙালির নাম বাদ পড়েছে। এর মধ্যে ২৫ লক্ষ হিন্দু আর বাকি ১৩ লক্ষ মুসলমান।"
বাংলা পক্ষের মতো প্রেসার গ্রুপগুলো বিজেপির উপর চাপ সৃষ্টি করছে [সৌজন্য: বাংলা পক্ষ]
বিজেপি যখন হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করে বাংলা জয়ের স্বপ্ন দেখছে, মমতা তখন বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির অনুভূতি তুলে ধরে এই বিভাজন রোধের চেষ্টা করছেন। ধর্ম নয়, ভাষা দিয়েই তিনি বাঙালির পরিচয় তুলে ধরতে চাইছেন।
তৃণমূলের সমর্থনে বাংলাপক্ষ-এর মতো বেশ কয়েকটি প্রেসার গ্রুপ হঠাই গজিয়ে উঠেছে যারা বাঙালির বাংলা ভাষা সম্পর্কিত অনুভূতিগুলোকে জাগ্রত করে তোলার চেষ্টা করছে ও বিজেপি বিরোধিতায় সরব হয়েছে।
বাংলাপক্ষের আহ্বায়ক তথা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসকাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গর্গ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, "দিলীপ ঘোষ এক কোটি বাঙালিকে হুমকি দিচ্ছেন, কারণ যারা সাম্প্রদায়িক ভাবে ফ্যাসিবাদী, দাঙ্গাবাজ এবং বাংলার পবিত্র মাটিকে কলুসিত করছে টাকা ছড়িয়ে, গোলমাল বাধানোর চেষ্টা করছে, তাদের বাঙালিরা ভোট তো দেবে না উল্টে এমন জবাব দেবে যে তাদের চোদ্দোপুরুষ সে কথা ভুলতে পারবে না।"
কিন্তু তৃণমূল পন্থী বুদ্ধিজীবীরাও এনআরসি নিয়ে বিজেপির বিরোধিতায় নেমেছে। মমতা নিজেও বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ করেছেন - রাজ্যের নাম বাংলা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন, ভারতজুড়ে নিট পরীক্ষা কেন শুধুই ইংরেজিতে হবে তা নিয়ে সরব হয়েছেন এবং রাজ্যের বিদ্যালয়গুলিতে বাংলা ভাষা আবশ্যিক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিজেপিকে বাঙালি বিরোধী বলে ঘোষণা করা হয়েছে [ফেসবুক]
সম্প্রতি অমিত শাহের একটি জনসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে পোস্টার দিয়ে বলা হয়েছিল যে বিজেপি আদতে বাঙালি বিরোধী একটি দল। এর উত্তরে অমিত শাহ বলে ছিলেন, "যে দলের প্রতিষ্ঠা শ্যামাপ্রসাদ মুখ্যোপাধ্যায়ের মতো একজন বাঙালি সেই দল কী ভাবে বাঙালি বিরোধী হতে পারে?" তিনি জানান যে বিজেপি রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দকে অনুসরণ করে এবং তাঁদের দেখানো পথেই তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে চলতে চায়।
বিজেপি তাদের ইতিহাসকে হাতিয়ার করে বঙ্গ সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছেন তখন মমতা অন্য একটি অস্ত্র ব্যবহারে উদ্যত হয়েছেন।
ইলিশ ও কি অনুপ্রবেশকারী? [ফেসবুক]
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, "অমিতজি ইলিশ খান না। ইলিশ এপার বাঙালিতেও পাওয়া যায় আবার ওপার বাংলাতেও পাওয়া যায়। আমি তাই ওঁকে জিজ্ঞেস করতে চাই - 'ইলিশও কি অনুপ্রবেশকারী?'
এবার বঙ্গ রাজনীতিতে যোগ হল নবতম রাজনৈতিক হাতিয়ার -বাঙালির অতিপ্রিয়, অতি সাধের ইলিশ মাছ।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে