মেদিনীপুরের সভায় মোদী যে অভিযোগ করেছিলেন তা কেন মেনে নিলেন মমতা?
তিনি বাকযুদ্ধে না জড়িয়ে সরকারি কর্মী ও দলের নেতাদের সতর্ক করছেন
- Total Shares
পঞ্চায়েত ভোটের রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে সাফল্যের পরে মেদিনীপুরে সভা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই সভায় এ রাজ্যের সিন্ডিকেট রাজ ও তৃণমূলের নেতাদের দাদাগিরি নিয়ে সরাসরি তোপ দেগেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তখন একটি দুর্ঘটনা ঘটায় অবশ্য সেই অভিযোগের তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারেননি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরে বিভিন্ন প্রশাসনিক সভায় তিনি দলের কর্মী তো বটেই, সরকারি কর্মীদের বিরুদ্ধে যে উষ্মা প্রকাশ করেছেন এবং নির্দেশ দিয়েছেন তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট, প্রধানমন্ত্রীর তোলা অভিযোগ তিনি মেনেই নিয়েছেন।
প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ছবি: ফেসবুক)
এ রাজ্যে সিন্ডিকেট রাজ ছিল না এমন নয়। সিন্ডিকেট নিয়ে গুলিও চলেছে। সরকারি কর্মীদের গা ছাড়া ভাব এমন এবং প্রতিটি ন্যায্য পরিষেবার জন্য যে ভাবে তাঁরা ঘুষ চান তাতে একটা ছড়া লোকের মুখে মুখে ঘুরত বাম আমলে, এখন এই পরিবর্তনের জমানাতেও তা একই ভাবে ঘোরে: “আসি যাই মাইনে পাই, কাজ করলে উপরি চাই।”
সাত বছর ক্ষমতায় থাকার পরে কেন এমন উপলব্ধি হল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের? বিজেপির শীর্ষ নেতা নরেন্দ্র মোদীর খোঁচা খাওয়ার পর?
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নিয়মিত ভাবে রাজ্যের সবক’টি জেলায় যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে গিয়ে প্রশাসনিক সভা করছেন এবং একই সঙ্গে জনসংযোগের কাজও করে যাচ্ছেন বছরভর। এবার জঙ্গলমহলে যে ভাবে বিজেপির উত্থান হয়েছে, তাতে মুখ্যমন্ত্রী মনে করছেন, সরকারি প্রকল্পের সুবিধা তৃণমূল স্তর পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না বলেই বিজেপির এই উত্থান।
পুরুলিয়ায় প্রশাসনিক বৈঠকে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “দেওয়াও হচ্ছে প্রচুর, করাও হচ্ছে প্রচুর। ইন্ডিভিজুয়ালি কারও কারও ব্যবহারের জন্য কেউ কেউ অখুশি হচ্ছে। এটা করা যাবে না। আরেকটি ব্যাপারেও আমি কঠোর ভাবে নির্দেশ দিচ্ছি: এখানে বিডিওরা আছেন, ডিএম-এসডিও সকলেই আছেন। জনপ্রতিনিধিরাও আছেন। যার রেশন কার্ড তার হাতে থাকবে। আবাস যোজনায় সরকার যে টাকা দেবে, সেখান থেকে কেউ যেন একটা টাকাও না কেটে নেয়। আমি কারোর কথা শুনব না। যাদের যা ভাতা আছে, তা কিষাণ ভাতাই হোক, বিধবা ভাতাই হোক, আদিবাসী ভাতাই হোক... তার ব্যাঙ্কের বই নিজের কাছে থাকবে, সব ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার হবে।”
লোকসভা ভোট যত এগিয়ে আসে ততই সব ধরনের সরকারি সুযোগের বিনিময়ে নির্বাচনী সুবিধা আদায় করতে চায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই। তৃণমূল কংগ্রেসও ব্যতিক্রমী নয়। তবে তৃণমূল কংগ্রেসনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জানেন যে তাঁর দলের কর্মীরা কী ভাবে তোলা তুলছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। তবে তিনি পুরো দায় নিজের দলের উপরে না নিয়ে নাম না করে বিজেপিকেও খোঁচা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ঝাড়খণ্ড থেকে অনেকে চলে আসে মাথায় ফেট্টি বেঁধে। এখানে টাকা তুলে চলে যাচ্ছে। এক্সটরশন করছে।”
ঝাড়খণ্ড থেকে এ রাজ্যে গুণ্ডারা এসে তোলা আদায় করছে বলে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে ‘মেনে নিয়েছেন’ তাতে তিনি তো পুলিশমন্ত্রী হিসাবে নিজের ব্যর্থতাকেই প্রতিষ্ঠিত করছেন! সেই ফাঁক অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী পূরণ করেছেন দুই রাজ্যের সীমানা এলাকার বিভিন্ন থানার ওসিদের সতর্ক করে। লক্ষ্যণীয়, তিনি জেলাশাসক-পুলিশসুপারদের এই দায়িত্ব দেননি। অর্থাৎ পুরো দায় তিনি নীচুস্তরের উপরেই চাপিয়ে দিয়েছেন।
রেশনের চাল সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন না। রেশন নিয়ে রাজ্যে আগুন জ্বলেছিল বাম জমার শেষ পর্বে। তখন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের পরেশ অধিকারী। তার পরে মোটামুটি এক দশক কেটে গেছে, হাল যে বদলায়নি সে কথা গ্রামের মানুষজন যে বুঝছেন এবং তার ফল কী ভাবে ভোটবাক্সে পড়ছে তা বুঝতে পারছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সরকারি প্রকল্প পাইয়ে দেওয়ার নামে তোলাবাজি বন্ধ করতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী (ছবি: ফেসবুক)
পুরুলিয়ার বৈঠকে তিনি বলেন, “খাদ্যসাথী প্রকল্পে আমরা খাদ্য দিচ্ছি। খাদ্য দফতর থেকে নজরদারি করতে হবে যাতে কোনও ডিস্ট্রিবিউটর, অর্থাৎ রেশন দোকানের মালিক, যেন বাজে খাবার না দেয় এবং যে ডিস্ট্রিবিউট করে দিয়ে আসছে সেই খাদ্য বা চাল (সেটি) যাতে বাজে না দেয় এটা লক্ষ্য রাখতে হবে। কিছু কিছু রোশন দোকান রেশন কার্ডও রেখে দেয়। ৫০ গ্রাম-১০০ গ্রাম করে কাটে বলে আমি শুনেছি। এটা যেন না হয়।”
তোলাবাজি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কলকাতার কলেজে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির সময় পথে নামতে হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীকে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কেও কলেজে যেতে হয়েছিল। কলকাতা শহরের বুকে তৃণমূলের ছাত্রনেতারা এমন দাপাদাপি করলে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে অবস্থা কেমন তা অনুমান করা যায়। গ্রামাঞ্চলের চেয়ে আরও খারাপ অবস্থা রাজ্যের আদিবাসী এলাকাগুলিতে।
রাজ্যের আদিবাসী এলাকায় অনাহারে মৃত্যুর খবর এসেছে, যদিও সরকার তা অস্বীকার করেছে। যে এলাকার লোক খেতে পায় না, সেখানে তারা মদ খেয়ে মারা গেছে এ কথা বিশ্বাস করা মুশকিল। সত্য কী তা জানেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তাই নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে অযথা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাকযুদ্ধে না জড়িয়ে তিনি দলের কর্মীদেরই শাসন করেছেন।
দলের নেতাদের ঔদ্ধত্য নিয়েও তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। কোনও প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নাম করে নেতারা যে টাকা নিচ্ছেন, সে কথাও ঘুরিয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি দলের কর্মীদের একাধিক কর্মীসভায় সতর্ক করেছেন।
পরিষেবা ঠিকমতো বণ্টন না করার দায় এড়াতে পারেন না সরকারি আধিকারিকরাও। তাঁদের মনোভাবও যে গয়ং গচ্ছ, সে কথা বুঝে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদেরও সতর্ক করেছেন। তবে তাঁরা কতটা সতর্ক হবেন সে কথা বলা মুশকিল।